নাগরিক দিনলিপি ১৪ :: পথের ওপারে..27th April 2020


******************************************

সুদীর্ঘ লকডাউন আমার কাছে বিকেলবেলাকে আবার প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে। দুপুরে ঘর থেকে অফিসের কাজ সেরে, বিশ্রাম সেরে, বাসন মেজে মনটা অজান্তেই বাইরে চলে যায়। অনেক বছর আগে এভাবে স্যারের কাছে ড্রয়িং শিখতাম বিকেলে, মন তখন ফুটবল খেলার মাঠে চলে যেত। এখন ভোর থেকে উঠে ফ্ল্যাট পরিষ্কার, রান্না, জামাকাপড় কাচা ইত্যাদির মতন সূর্যাস্ত দেখাটাও রোজনামচায়। জোরে হাঁটতে হাঁটতে কখনও শুনি গান, কখনও অডিও বুক। অথবা ছাদে উঠে কোন কোনদিন পকেটে হাত দিয়ে আকাশ দেখা। শহরের ওপর অভিমান ভুলে আবার ফিরে আসা চড়াইয়ের দল, কালচে হতে থাকা নীল আকাশ, হলদে হতে থাকা সাদা মেঘের দল আর ঘুড়ি। আসলে নারকেল গাছগুলির মাথায় অনেক ঘুড়ি আটকে আছে, মহামারীতে নিরাপদ বাড়ির সদস্যরা অনেকেই ঘুড়ি ওড়ান। আমাদের বাড়ির নারকেল গাছেও আগে প্রায়ই এমন ভো-কাট্টা ঘুড়ি আটকে থাকত।

এখানে ফ্ল্যাটের পাঁচিলের গায়ে বড় রাস্তা, ডানদিকে সূর্যাস্ত দেখা যায়। রাস্তার ওপারে সাদা রঙের বাড়িতে চোখ যেতেই চোখ পড়ল সেই বৃদ্ধার দিকে, কয়েকদিনে ও আবিষ্কার করেছি এই বাড়িতে বাস করেন এক বৃদ্ধা। উনি হুইল চেয়ারে বসে থাকেন, একজন ওঁকে হুইলচেয়ার ঠেলে ঠেলে নিয়ে যায়, সম্ভবত ওঁর পরিচারিকা। আজ উঁচু ফ্ল্যাট থেকে তাকাতেই দেখি অন্য দৃশ্য। দোতলা বাড়ির বারান্দা ও বসার ঘরের যেটুকু দেখা যায় সেই অংশে দেখি বৃদ্ধার পা, ওয়াকার নিয়ে টলমল করতে করতে হাঁটছেন। প্রতি পদক্ষেপেই পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা, অবশেষে এসে হুইল চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লেন। টেবিল থেকে চশমা নিলেন, তারপর হুইল চেয়ার নিয়ে বারান্দায় এসে তাকালেন যেন সোজা আমার দিকেই। আগে কয়েকবার চোখাচোখি হয়েছে ঠিকই, তাতে কি উৎসাহ বেশিই প্রকাশ পেয়েছে? একটু দোনামনায় লজ্জিত হয়ে কয়েক পা পিছিয়ে, সরে গেলাম এক ফ্ল্যাটবাড়ির দিকে,যেখানে ছাদে সবাই মন দিয়ে ক্রিকেট খেলে।

ফ্ল্যাটবাড়ি বললে ভুল হবে, বরং তিনটি ফ্ল্যাটবাড়ির আবাসন বলা উচিত। প্রথমটির ছাদে কয়েকজন মহিলা শরীরচর্চা করেন, একটি বাচ্চা মেয়ে মাঝে মাঝে নিজের মনে স্কিপিং করে। পরেরটিতে এক ভদ্রলোক উঠে মন দিয়ে পাশের ছাদে শরীরচর্চা দেখেন, আর খেলা করে একটি বাচ্চা মেয়ে ওর বাবার সাথে। আরেকটি ছাদে ক্রিকেট খেলে দশ/বারো জন। বেশ সময় কেটে যায় এদের খেলা দেখতে দেখতে। এই দলের বেশিরভাগ সদস্য কিশোর হলেও দূর থেকে মনে হয় উইকেটকিপার পঞ্চাশোর্ধ। খানিক খেলা দেখে  আবার মনে পড়ে গেল বৃদ্ধার কথা, আজ কেন একা একা ওয়াকার নিয়ে হাঁটছিলেন কে জানে।

এবার দেখলাম ভদ্রমহিলা একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন রাস্তার দিকে। ঘনঘন এদিক ওদিক ঘাড় ঘুরিয়ে কাউকে খুঁজছেন। ওঁর পরিচারিকাকেই হয়ত, নাকি কারুর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছেন! একবার ভেবে, একটু নীচু হয়ে ঘরের ভেতর আরো কিছুটা উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম, সত্যিই উনি একা কিনা। এমন সময়েই ভদ্রমহিলা আবার চোখ তুলে তাকালেন। এভাবে উঁকি দিতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়ে তাড়াতাড়ি সরে গেলাম। উল্টোদিকে যেতে যেতে মনে হল, ভদ্রমহিলা মনে হয় হাতের ইশারা করতে যাচ্ছিলেন।

পিছনের বাড়ির ছাদে সাদা ধুতি পরিহিত এক কর্মঠ প্রৌঢ় ও তাঁর নাতিকে দেখা যায়। উনি পাইপে করে ছাদের ফুলের টবে জল দেন, আরেকটু আগে এলে ওঁকে দেখা যেত ফুলগাছগুলির গোড়া পরিচর্যা করতে। বাগান দেখে মায়ের কথা মনে পড়তেই আবার গুটিগুটি পায়ে এসে দাঁড়ালাম রাস্তার দিকে। সন্ধে নামছে, ওই সাদা বাড়ির দোতলার বারান্দা থেকে উনি কি কিছু বলতে চাইছিলেন! অন্ধকার নেমে এলে আর দেখাও যাবে না, তাই সংশয় দূর করতে শেষবারের মতন এলাম রাস্তার দিকে।

এবার দেখলাম উনি সোজা আমাদের ছাদের দিকেই তাকিয়ে আছেন, দাঁড়াতেই হাতের ইশারা করলেন। নিশ্চিত হয়ে নিলাম আমাকেই ডাকা হচ্ছে কিনা। নিশ্চিত হয়ে, মাস্ক পরে, দ্রুতপায়ে লিফটের দিকে রওনা দিলাম। নির্ঘাত কোন বিপদ, আর্থিকভাবে তো স্বচ্ছলই মনে হয়। তাহলে কি ওঁর পরিচারিকা কিছু হাতিয়েছে, নাকি ওষুধপত্র দরকার, নাকি ওঁর করোনার উপসর্গ দেখা দিয়েছে বলে পরিচারিকা পালিয়েছে!
-------------------------------------
বাড়ির নীচে যেতেই উপর থেকে চাবির গোছা নামিয়ে দিলেন। ঢুকে দেখলাম প্রসন্ন মুখে টিভি'র সামনে অপেক্ষা করতে করছেন বৃদ্ধা। নমস্কার জানিয়ে বসতে বললেন, ওঁর নাম গৌরি মজুমদার। প্রথমে আমাকে উদ্বিগ্ন দেখে জানতে চাইলেন আমি কি ভেবে এসেছি। তারপর শুরু করলেন ওঁর অংশের গল্পটা। গৌরিমাসিমা অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, এই বাড়িতে চার দশকের বসবাস, যার মধ্যে শেষ বাইশ বছর প্রায় একা। মেয়ে বস্টনে সংসার পেতেছে প্রায় দশ বছর, বছর কয়েক আগে শেষ গোল্ডেন রিট্রিভার মারা যাওয়ার পর আর নতুন পোষ্যও আসেনি। সঙ্গী বলতে সারা দিনের পরিচারিকা উর্মিলা। মেরুদন্ডের একটি টিউমার অপারেশনের পর ওঁর আয়ুরেখা কিছুটা প্রলম্বিত হলেও, গৌরি শেষ তিন বছর আছেন হুইল চেয়ারের আশ্রয়েই। মশকবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়ায় বেশিরভাগ সময়েই দোতলাতেই কাটে। অন্য কোন বার্ধক্যঘটিত সমস্যা এখনও বিশেষ একটা না থাকায় গৌরি পুরোপুরি পরনির্ভরশীল নন। শৌচাগা্রের ব্যবহার, জামাকাপড় বদলানো, নিজের খাবার নেওয়া ইত্যাদি নিজেই করেন। দিনে কমপক্ষে একবার ওয়াকার নিয়ে নিজে নিজে হাঁটেন। উর্মিলা নার্সিংয়ের ট্রেনিং নিয়েছে, বললেন এমনিতে ভাল মেয়ে তবে রান্নাটা ভাল না। যেহেতু গৌরি নিজে আজকাল খান খুবই কম, তাই রান্নার বিষয়টা খুব সমস্যার নয়।

আজ সকালে মেয়েটির দাদা এসে ভোরবেলা বাড়ি নিয়ে গেছে। ওদের বাবা খুব অসুস্থ, কিন্ত মহামারীর কারণে হাসপাতালে ভর্তি করার মতন অবস্থা নেই। অবস্থা আর একটু খারাপ হলে সম্ভবত আর বাঁচানো যাবে না। লকডাউনের সময় প্রচন্ড কড়াকড়ি, তাই শেষ রাতে ওর দাদা এসে বাইকে করে নিয়ে গেছে। আবার মাঝরাতে দিয়ে যাবে, আজকের দিনটা গৌরিমাসিমা একা। এমনিতে একদিনে ওঁর নিজের খুব অসুবিধা কিছু নেই, কিন্ত অসুবিধায় পড়েছে একটা অসুস্থ বাছুর।

গৌরিমাসিমার নিজের বাড়ির একতলায় ভাড়া আছে এক মোবাইল কোম্পানি। বাড়ির সামনে বড় রাস্তা, পেরিয়ে সোজাসুজি একটি চারতলা ফ্ল্যাটবাড়ির প্রাচীর। তার গায়ে শুয়ে আছে একটি অসুস্থ বাছুর। দিন কয়েক আগে পথ দুর্ঘটনায় সে জখম হয়েছিল, সামনের পায়ের অবস্থা দৃশ্যতই খারাপ। কেউ এসে ফ্ল্যাটবাড়ির লাগোয়া ফুটপাথে শুইয়ে দিয়ে গেছে। তারপর থেকে তাকে দিনে তিনবার করে খাবার দিচ্ছেন উনি। অবশ্য গৌরিমাসিমা না বলে উর্মিলা বললেই ঠিক হয়, নিজের হাতে বালতিতে করে খাবার নিয়ে সেই বাছুরের মুখের কাছে ধরে। প্রথমদিন মনে হয়েছিল ও মারাই যাবে, তাই শেষবারের মতন জল বা খাবার দিতে চেয়েছিলেন ওঁরা। দুদিন পর দেখা গেল ব্যাটার জান আছে, খিদে বাড়ল। দিন দু'য়েক হল ও উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করছে। এর মধ্যে আজ খাবার পাওয়াটা দরকার।

সামনের এটিএমের যে সিকিওরিটি গার্ড থাকেন তাঁকেও আজ সকাল থেকে দেখা যায়নি। উনি ভেবেছিলেন ঝুড়িতে আলাদা করে রাখা খাবার সিকিওরিটি গার্ডের হাতে বাছুরটিকে পৌঁছে দেবেন, সেটা হলনা। দুপুর থেকেই বাছুরটা যেন কিছু খুঁজছে, আজ জলও পায়নি। এদিকে বিকেল হয়ে যেতে, হঠাৎ গৌরির মাথায় এল সামনের ফ্ল্যাটবাড়ির ছাদের ছেলেটার কথা। সেই ছেলেটিকে ডাকা যেতে পারে। বিকেল হতেই তাই চশমা পরে গৌরি বারান্দায় হুইল চেয়ার নিয়ে এসেছিলেন, কিন্ত চোখাচোখি হওয়া মাত্রই সে সরে গেল। গৌরি একটু বিরক্ত হয়েও অপেক্ষা করেছিলেন ছেলেটির। আবার কিছুক্ষণ এ টি এমের গার্ডের দিকে তাকিয়ে হতাশ হয়ে আবার ছাদের দিকে তাকাতেই ছেলেটিকে দেখলেন, সে দ্রুত সরে গেল।

গৌরি চিন্তায় পড়লেন। একে মেঘ তারপর সন্ধে হয়ে আসছে, এরপর ইশারা করলেও হয়ত ও দেখতে পাবে না। অন্য ছাদে বা রাস্তায় কাউকে দেখা যাচ্ছে না। ছেলেটিকে ইশারা করলেই বা সে কি ভাববে। ও তো ভাবতেই পারে ভদ্রমহিলা ওঁকে এদিকে তাকাতে দেখে বিরক্ত হচ্ছে। বাছুরের বিষয়টা বুঝবে কি করে। বাছুরটা যেখানে পড়ে আছে সেটা হল ওদের প্রাচীরের বাইরের দেওয়াল, ওর ফ্ল্যাটবাড়ির বাসিন্দারা ওকে দেখতে পাবে না। আবার গৌরির ক্ষীণ স্বর ওই ছাদ পৌঁছবে না। আর যদি একবার এদিকে আসে ছেলেটি তাহলে দেখামাত্রই যেভাবে হোক ডাকতে হবে। গৌরি একমনে তাকিয়ে থাকলেন ফ্ল্যাটবাড়ির ছাদের দিকে। ছেলেটি এদিকে তাকাতেই সব উদ্যম এক করে, হাত নেড়ে ডাকলেন। সরে গেলনা এবার, বরং নিজের দিকে তর্জনী নির্দেশ করে ইশারায় নিশ্চিত হল ওকেই ডাকা হচ্ছে কিনা। তারপর এক মুহূর্ত ভেবে, হাত তুলে আশ্বাস দিয়ে বোঝাল সে আসছে।

*******
অসুস্থ ঘোড়া বা গবাদি পশুকে বালতিতে করে খাওয়ানো আমার কাছে নতুন নয়। কৃষ্ণনগরের বাড়ির সামনেই আছে এক বড়সড় পশু হাসপাতাল। তার সামনে রাস্তায় মাঝেমাঝেই রেখে যাওয়া হত দুর্ঘটনাগ্রস্ত গবাদি পশু, আমরা পাড়ার ছেলেমেয়েরা প্রাণমন ঢেলে পড়ে যেতাম তাদের সেবায়। বেশিরভাগই বিফলে গেছে। গৌরি মাসিমার ঘর থেকে ওঠার সময়ে নিয়ে নিয়েছি ওঁর ফোন নম্বর। ভাত, ডাল, কাঁচা সব্জি ভর্তি বালতি নিয়ে নামার সময় মনটা খুশিই ছিল কাল। প্রথমত গৌরিমাসিমার কোন বড় বিপদ হয়নি, দ্বিতীয়ত আবার ছেলেবেলার পরিচিত কাজ আমার কাছে হাজির। আর্ত পশুকে সেবা করার সুযোগ পেয়েছি, তবে এবার বালতি হাতে আমি আর্তকে সেবা করতে যাওয়ার আগেই সে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে।

Comments

Popular posts from this blog

মনন..10th Feb 2019

নাগরিক দিনলিপি ১০ : 30 th Aug 2019

মনন...2nd Nov 2019