যেতে যেতে ১১: কালপুরুষের সন্ধানে:: 26th May 2019


**********************************

সন্ধেবেলা কায়রোর "রামেসিস" স্টেশন থেকে রাতের ট্রেন কিছুটা যেতেই আবছায়ায় ফুটে ওঠে সাহারা। নীলের পাশ দিয়েই গেছে এই লাইন আসওয়ান শহর অবধি। ফুটে উঠতে থাকে অসংখ্য খেজুর গাছের অবয়ব। সব পেরিয়ে যায়, দুজন বাদে। আমি আর আমার গল্প শোনা, অনুচ্চ টিলার মাথার ওপর, কালপুরুষ। কালপুরুষ তার কর্মে 
অবিচল। প্রতি রাতে সে ধনুক নিয়ে মহাকালের সৈনিক। আমি নিশ্চিত সে সাধারণ এক শিকারি নয়। 

রাতে ট্রেন থেকে "লাক্সর"-এ নামতেই ঠাণ্ডা শুকনো বাতাস আমায় অভর্থ্যনা জানাল। দূর থেকে ভেসে আসছে ফজরের নামাজের আজান। স্টেশন থেকে বেরিয়েই দেখা যায় "ভ্যালি অফ কিংস"এর ওপর দিয়ে উড়ছে বেলুন। 

আমি আবার আরেক মরুভূমির দেশে। 

চলেছি কায়রো ছড়িয়ে মিশরের দক্ষিণ দিকে। দক্ষিণ হলেও এদিকটা উত্তরের থেকে উচুঁ। ভুমিরূপ আমাদের উল্টো। সমুদ্রতলের নিরিখে। এখান থেকে সুদান দূর নয়। সেও গল্প নিয়ে শোনানোর অপেক্ষায় আরেক মরুভূমির দেশ।

আমার কিন্ত মরুভূমি ভালোই লাগে। মরুভূমির মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় আমি শূন্য দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকি অসীম কোন বিন্দুতে। ভাবি কি করে আর কতদিন ধরে পাহাড়গুলো পাথর হল। তারপর বালি। তারপর সাহারা। এভাবেই আমাদের অভিমান জমে পাহাড় হয়। একসময় পাহাড় বোঝে সে যত বড়ই হোক, আকাশের চেয়ে নয়। তখন আবার অভিমানগুলো শুকিয়ে যেতে থাকে। মরুভূমি হয়।

সাহারা ছড়িয়ে আছে মিশর থেকে মরক্কো, আলজিরিয়া, তিউনিসিয়া, লিবিয়া, চাদ, সুদান, নাইজার, মালি। পুরো উত্তর আফ্রিকা। পড়ছিলাম ১০,০০০ বছর আগে সাহারার আবহাওয়া অপেক্ষাকৃত আর্দ্র ও শীতল ছিল, বেশ কিছু হ্রদ ও ছোট নদীর অবস্থানের প্রমাণ পাওয়া যায়। বর্তমানে শুষ্ক মরুভূমি, এমন কিছু অঞ্চলের পাহাড়ের গুহায় আদিম মানুষের বসবাসের চিহ্ন (গুহাচিত্র ও পাথরের যন্ত্রপাতি) পাওয়া গেছে যা থেকে বোঝা যায় ঐ এলাকা থেকে এক সময়ে সহজে জল পাওয়া যেত।  সেটা সত্যি হলে ফারাওরা কেন এখানে পিরামিড বানিয়েছিলেন তার একটা ব্যাখ্যা মেলে।

আমি বড় বোকা, সব কিছুর ব্যাখ্যা খুঁজে বেড়াই। এদিকে নিজের কাজকর্মের ব্যাখ্যা পাইনা।

তবে ব্যখ্যা মেলে না অনেক কিছুরই। যেমন- কেন ফারাওরা নিজেরা মাটির ইটের বাড়িতে থাকত। সেই বাড়িগুলো খুঁজে পাওয়া যায়না। সেগুলো ধূলিসাৎ হয়েছে। বেঁচে আছে পিরামিড আর প্রচুর মন্দির। এত জ্যামিতির, রসায়নের, শারীরবিদ্যার, শিল্পের জ্ঞান নিয়েও অমরত্বের সাধ যায়না। অবশ্য দেহ নাইবা হল। এদের কীর্তিগুলো অমর হয়েছে। এঁদের উপাসনার স্থানকে মন্দির বলা হয়। এমনকি ভারতীয় সভ্যতার সঙ্গে অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যায়। সূর্যমন্দির আমাদের দেশে "কোনারক", ওদের দেশে "কার্নাক"। ওঁরাও পুনর্জন্ম বিশ্বাসী। আমাদের গাইড "ইয়াশরী" একটা মজার পুরানের গল্প বলল। আমাদের একটি গল্পের সঙ্গে মিলও আছে, চলুন শোনাই।

মিশরীয় পুরানের অন্যতম প্রাচীন দেবতা "অসাইরিস"। তাঁর সঙ্গে বিয়ে হয় দেবী "আইসিস" এর। অসাইরিস ছিলেন আকাশদেবতার সন্তান। তিনি আইসিসকে বিয়ে করলেও ওঁর ভাইও আইসিসকে ভালবাসতেন। এঁর নাম ছিল "সেত"। অসাইরিস তাই পড়লেন সেত-এর রোষে। এক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সেত খুন করলেন অসাইরিসকে। এরপর তাঁর দেহাংশ বিয়াল্লিশ টুকরো করে সারা দেশে ছড়িয়ে দিলেন, কিন্ত আইসিসকে পেলেন না। আইসিস প্রতিহিংসায় জ্বলতে জ্বলতে আত্মগোপন করলেন। তারপর খুঁজে বের করলেন একচল্লিশটি টুকরো। আইসিস জানতেন মৃতের দেহে কিভাবে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে হয়। শেষ টুকরোটি জলে পড়েছিল, একটি মাছ খেয়ে নেয়। একটি কাপড়ের ব্যান্ডেজ জড়িয়ে অসাইরাসকে একত্রিত করা হয়েছিল, সেই হিসেবে অসাইরাস হলেন পৃথিবীর প্রথম মমি।

যা বলছিলাম। তবে যে জন্য এত পরিশ্রম সেই কাজ হলোনা শেষ টুকরো না পাওয়ায়। অসাইরাস তাই প্রাণ পেলেন না, আইসিস প্রতিশোধের শপথ নিলেন। গর্ভে সন্তান "হোরাস"কে নিয়ে চলে গেলেন গোপন ডেরায়- নীলনদের অববাহিকায় ক্ষেমিসের প্যাপিরাস জঙ্গলে আত্মগোপন করে। নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে বাধ্য হন তিনি। প্যাপিরাস জঙ্গল মূলত একটি ক্ষুদ্রাকায় ভাসমান দ্বীপ। আইসিস এখানেই হোরাসকে জন্ম দেন। তাকে বড়ও করেন এখানেই। এ কারণে দ্বীপটিকে হোরাসের দ্বীপ বলা হয়। দেবতা হোরাসের শরীর মানুষের মত হলেও মাথা ছিল বাজপাখির মত। 

এই হোরাস বড় হবেন এবং কাকার সঙ্গে যুদ্ধে নামবেন এবং Poetic Justice পাবেন, সহজেই অনুমেয়। তবে অনেক দফায় চলা সেই যুদ্ধ জিততে হোরাস নিজের একটি চোখ হারান। মিশরীয়দের অনেক শিল্পেই হোরাসের একটি চোখ দেখতে পাওয়া যায়। সেতের সাথে যুদ্ধে চোখ হারানোর পর সূর্য এবং চন্দ্র তার চোখে পরিণত হয়। তখন থেকেই চোখ মিশর রক্ষার প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। বাজপাখিও হোরাসের আর এক প্রতীক। এডফু শহরে সব চাইতে বেশী সুরক্ষিত মন্দির দেবতা হোরাসের নামে রয়েছে । নিচে ঐ মন্দিরের সামনের হোরাস মূর্তি দেখা যাচ্ছে ।

এই প্রতিশোধ আর পুরানের গল্পের মিল কী চিরন্তন! পরে বাইজেন্টাইন সেনারা এসে এক মন্দিরের দেওয়ালে দেখে মায়ের বুকে শিশুপুত্র হোরাস দুগ্ধপানরত। তারা সব মিশরীয় স্থাপত্য ভাঙতে ভাঙতে আসছিল। এসে দেখে- এ তো শিশু যীশু, মাতা মেরির ক্রোড়ে, দুগ্ধ পান করছে! বাইজেন্টাইন বাহিনী এই চিত্রকর্মগুলোকে অস্বীকার করবে কি করে? তারা তো খ্রিস্ট ধর্মের প্রসারকেই ব্রত হিসেবে নিয়েছিল। সুতরাং তারা ভুল বুঝে, ভুল বিশ্বাসে আইসিসের বুকে শিশু হোরাসকে রক্ষা করেছে- মাতা মেরির ক্রোড়ে শিশু যীশু ভেবে। বাকি সব ভাস্কর্য তারা নষ্ট করলেও আইসিসের কোলে হোরাসের ভাস্কর্য করেনি।

সন্ধে নামছে। আমাদের গাইড একটু সময় দিয়েছেন এডফু শহরের পাশে নীলের পাড়ে সময় কাটাতে। সাহারার বুকে দিন ঘুমিয়ে পড়েছে, রাত জেগে উঠছে। আড়মোড়া ভেঙ্গে হাতে ধনুক নিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে "অসাইরিস"রূপী কালপুরুষ, সাথে লুব্ধক। নদীর নীল জল রাত্রির রঙে নিজেকে রাঙিয়ে নিয়েছে। নীলের জলে ভেসে বেড়াচ্ছে কিছু প্রদীপের মত "ফেলুকা"। সাহারার ঠান্ডা বাতাসে মরুভূমি থেকে ভেসে আসছে পুনরুজ্জীবনের গল্পগুলো। আমি আবার অনেক খণ্ডে ভেঙ্গে যাচ্ছি। আমার মনের ওপর কাটাকুটি খেলছে "অসাইরিস"আর কালপুরুষ, নীল আর জলঙ্গী, সাহারা আর গাঙ্গেয় পললভূমি, এক চল্লিশের নাগরিক আর ছয় বছরের বালক।

আমি রেলিংয়ে ভর দিয়ে কানের কাছে এক প্রৌঢ় ভদ্রলোকের হাঁপানি সম্বলিত নিঃশ্বাসের আওয়াজ পাচ্ছি। আটের দশকের প্রথমভাগে লোডশেডিং-এর রাতে, বাড়ির উঠানে, খেজুরপাতায় বোনা মাদুরে শুয়ে আমার সঙ্গে আকাশের কালপুরুষ দেখতেন এক পরাজিত বিপ্লবী। 

আজ মনে হচ্ছে আমার পাশেই শুয়ে থাকতেন এক কালপুরুষ, যিনি রাত হলেই ঘন অন্ধকারে এক নক্ষত্রের মধ্যে নিজের হারানো ধনুকের সন্ধান করতেন।

সেই হারানো ধনুকের সন্ধানী হয়ত আমিও। প্রজন্ম বদলে যায়, কালপুরুষ কিন্ত আজও তার পৌরুষে মহাকালের পটে অধিষ্ঠিত।

Comments

Popular posts from this blog

মনন..10th Feb 2019

নাগরিক দিনলিপি ১০ : 30 th Aug 2019

মনন...2nd Nov 2019