নাগরিক দিনলিপি ৪

গরমকালকে বোধহয় আনুষ্ঠানিক বিদায় জানায় রাধাচূড়া আর কৃষ্ণচূড়া। বৃষ্টিতে, নিঃশব্দে ঝরে গিয়ে। ময়দানে ক্যামেরা নিয়ে আজ ঘুরতে ঘুরতে মনে হল। তবে গরমকাল চলে গেল মানেই গরমের থেকে নিষ্কৃতি নেই। যেমন খারাপ সময় গেলেই ভাল সময় চলে আসে না। বৃষ্টি ভাল হয়নি এ বছর। খুব ঘাম হচ্ছে। হেঁটে গলদঘর্ম হয়ে বসলাম এক গাছতলায়। রুমাল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে খেয়াল করলাম ওপাশে বসে আছে এক বৃহন্নলা। মানে হিজরে।
আমায় দেখে এসে বলল, বাবু কিছু টাকা দে।

বললাম, না। দেব না।
- কেন দিবিনা?
- আমি দিইনা। তাই।
- তাহলে সিগারেট দে একটা।
- নেই।
- ধুর। 
বলে একটা বিড়ি বের করল। তারপর ফুঁ দিয়ে বলল, দেশলাই আছে?
- নাহ।
- তুই কি রে! ঘাড় নাড়া পুতুল নাকি। কিছুই তো নেই। দেখি তাহলে একটা ছবি তুলে দে।

ক্যামেরার শাটার সশব্দে তার কাজ করেছে জানাল। এমনিতে হিজরেদের আমি ভয় পাইনা। দেখলে শরীর খারাপও করে না। আমার সপ্রতিভ আচরণ ওকে মনে হয় অবাক করল। বলল, তুই কি রিপোর্টার?

- না। তুমি তো মেয়েদের সালোয়ার পরেছ। তুমি কি মেয়ে?

এবার সে ঘাড় নেড়ে চুপ করল। আমারও মনে হল প্রশ্নটা বাজে হয়েছে। দায়িত্বজ্ঞানহীন, অযথাই। তাই কথা পালটে বললাম, তোমার নাম কি?

- স্বপ্না।
- কোথায় থাক?
- আমাদের তোদের মতন বাড়িঘর হয়না। আমরা একসাথে থাকি। 
একটু চুপ করে ভাবলাম। তারপর সাহস করে বললাম, কখনই ছিলনা?
- কেন রে তোর কি দরকার?

চুপ করে থাকলাম। একটু পর স্বপ্না বলল, সরি। ছিল, বুঝলি।

- ও
- কোথায় ছিল জিজ্ঞেস করলি না?
- নাহ।
- কাঁচড়াপাড়া। নাম শুনেছিস?
- হ্যাঁ।
- কবে এলে এদের সঙ্গে?
- আমি আসিনি। আমাকে বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছে জোর করে। 
- কেউ কিছু বলেনি? 
- কে বলবে! বাবা স্কুলে পড়াত। বাবাকে নিয়ে সবাই হাসাহাসি করত। আমাকে নিয়েও করত। আমিও স্কুলে যেতাম একসময়। ইংরেজিতে ভাল ছিলাম। এখনও কাগজ পড়ি হাতে পেলে।

চুপ করে রইলাম। এতটা বিশদে জানতে চাইনি। খারাপ লাগছিল।
ও নিজেই বলল, আসার পর খারাপ লাগত। এখন ভালই লাগে। আমাদের জীবন তোদের চেয়ে আলাদা। আমাদের সৎকারও আলাদাভাবে হয়। ভাবিস না খারাপ আছি। টাকাপয়সা ইনকাম করি। চিন্তা কি?

- বাড়ি গেছ আর কখনও?
- একবার। দেখে মা কাঁদছিল। বাবা মারা যায় তার পরদিন।
- মাকে কেউ দেখে?
- ভাই আছে রে!
- চাকরি করে? 
- দোকান করেছে একটা। আমিই টাকা দিয়ে সাহায্য করলাম।
- সে কি!
- ও মা। আমার ভাইকে কি তুই সাহায্য করবি নাকি!
- ভাই ভালবাসে? 
- হ্যাঁ। এবার বলবি বাড়ি যাই না কে? ওরে আমাদের কেউ বাড়িতে ফিরিয়ে নেয় না। তাই বলে কি ভাইকে আমি দেখব না? ও আর আমার ভাইপোই তো সব আমার। আমাকে ভাইপো ভাল না বাসলেও আমার সব ওকে দিয়ে যাব।

ইতিমধ্যে স্বপ্নার এক সঙ্গী হাজির। এসে সজোরে হাততালি দিয়ে বলল, স্বপ্না তুই কি বাবুর সঙ্গে প্রেম করছিস?

- এই বাবুকে কিছু বলিস না। আমার চেনা লোক। 
- আচ্ছা। আমিও বসি। আরো আশি টাকা কালেকশন হল বুঝলি!

এক ভেলপুরিওয়ালা এল। তার থেকে আগুন নিয়ে ওরা বিড়ি ধরাল। দেখলাম এদের ভালই আলাপ। ভেলপুরি খাওয়াল ওদের নিখরচায়। 

শহরের পথে কিভাবে মানুষ মানুষের কাছে চলে আসে। বড় অদ্ভুত এই দুনিয়া। স্বপ্না বলল বটে আমি ওর চেনা। আমি ওকে চিনলাম। নাহলে জীবন অপূর্ণ থাকত।

কলকাতা খুব একটা বয়স্ক শহর নয়। শ' তিনেক বছর কিছুই না। দামেস্ক, বেইরুট এমনকি বারানসীর চেয়েও অনেক ছোট। এগুলো প্রায় তিন হাজারের ঘরে। কোন এক সময়ে এই শহর ছিল ব্রিটিশ সরকারের কাছে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ শহর। আজ ভারতেরই ষষ্ঠ বা সপ্তম স্থানে। তবে মানবিকতার দিক থেকে বাঙালি এগিয়ে। গর্ব হল স্বপ্নার জন্য। অনেকটাই ও আমার সহনাগরিক ও বাঙালি বলে। জানিনা অন্য শহরের হিজরের জীবনকাহিনী বা ফেরিওয়ালার কথা। তবে ভারতের বেশিরভাগ মানুষ বড় উগ্র।কটুভাষী। আক্রমনাত্মক। হিংসাত্মক। এবং বড় অপ্রয়োজনীয়ভাবে।
যেভাবে এই শহরে মানুষকে শোষণ করা হয়, তোলাবাজেরা উত্যক্ত করে, প্রশাসন জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছে - তার পরেও আমরা এখনও অনেক সৎ। অনেক সম্মান দিই মানুষকে। আজ চাকরির অভাবে আর অপমানে সবাই দুষ্কৃতিকারী হয়ে গেলে কি সত্যিই কিছু বলার ছিল?
স্বপ্না ওর ভাইকে ভাল না বাসলে ওর কি সত্যিই কি দোষ হত? গীতায় পড়া বানী আমি আয়ত্ব করতে পারিনি। ফলের চিন্তা ছাড়া কাজ করিনা। স্বপ্না তাহলে কে? ওকে এই বানী কি কেউ ব্যাখ্যা করেছে? ওর কথা ঠিকঠাক হলে ও কি সাধারন মানুষ?
সব তালগোল পেকে গেল কে কাপুরুষ কে নপুংসক আর কে মহাপুরুষ। ওর ভাইপোর জন্য একশ টাকা দিয়ে উঠে পড়লাম।
ময়দানে পড়ে থাকা ঝরা কৃষ্ণচূড়াও বড় সুন্দর। একটা তুলে আনলাম।
ঝরে পড়া দোষ নয়। একটু সাবধানে হাঁটতে থাকলাম। আর কোন ফুল পাড়িয়ে দিতে চাইনা।

Comments

Popular posts from this blog

মনন..10th Feb 2019

যেতে যেতে ৫ :: 22nd July 2018

যেতে যেতে ৪ : 7th July 2018