Posts

Showing posts from May, 2019

নাগরিক দিনলিপি ৫

Image
একাদশীর দিন সকালে কলকাতার ক্লান্তিটা ধরা পড়ে। সারারাত ধরে জ্বলা স্ট্রীটল্যাম্পের আলো কেউ বন্ধ করতে আসেনি। পুজোর সময়ে এত আলো, তাও ওদের অব্যাহতি দেওয়া হয়নি। আজ আলোকসজ্জায় যখন সারা শহর ভেসে যাচ্ছে তখনও এরা দৃপ্ততার সঙ্গে দাঁড়িয়ে। চোখ ধাঁধানো আলোর পাশে হীনমন্যতায় ভুগছে না। চিরাচরিত শৃঙ্খলায় উজ্জ্বল। একই কোণে দাঁড়িয়ে আলো দিয়ে যাচ্ছে তার আত্মজ বৃত্তাকার অংশকে। যে কয়েকটি পাখি এদের সৃষ্ট আলোকদূষণের শিকার হয়ে কিচিরমিচির করে রোজ, তারা শব্দবাজির দাপটে পালিয়েছে। ওদিকে পথে কম যানবাহন। রাস্তা ফাঁকাই প্রায়। রাস্তা থেকে গবাদি পশু বা কুকুরগুলো জনজোয়ারে বিপন্ন হয়ে কোনো গলিতে বা এলাকাছাড়া। মাঝে মাঝেই পড়ে আছে ফানুসের কংকাল। আগের রাতেই যারা 'আকাশপ্রদীপ'-এর মতন কাব্যিক নাম পেয়েছিল। রাস্তার মোড়ে খবরের কাগজের দোকান এবং চায়ের দোকানগুলো বন্ধ। ফুটপাথও ফাঁকা। সন্ধেবেলা প্রতিমা নিরঞ্জনের পর ঠাকুরের বেদীতে প্রদীপ জ্বলতে দেখা যায়। সে দীপ্তি বড় করুন। হারানো মানুষের ফেরার আশায় মানুষের মনে যেভাবে আশার আলো জ্বলে, অনেকটা তেমন। তার শিখা থেকে বিষাদ ধার করে শহরের জড়পদার্থের গায়েও যেন মৃদু প্রাণের স্পন্দন।

নাগরিক দিনলিপি ৪

Image
গরমকালকে বোধহয় আনুষ্ঠানিক বিদায় জানায় রাধাচূড়া আর কৃষ্ণচূড়া। বৃষ্টিতে, নিঃশব্দে ঝরে গিয়ে। ময়দানে ক্যামেরা নিয়ে আজ ঘুরতে ঘুরতে মনে হল। তবে গরমকাল চলে গেল মানেই গরমের থেকে নিষ্কৃতি নেই। যেমন খারাপ সময় গেলেই ভাল সময় চলে আসে না। বৃষ্টি ভাল হয়নি এ বছর। খুব ঘাম হচ্ছে। হেঁটে গলদঘর্ম হয়ে বসলাম এক গাছতলায়। রুমাল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে খেয়াল করলাম ওপাশে বসে আছে এক বৃহন্নলা। মানে হিজরে। আমায় দেখে এসে বলল, বাবু কিছু টাকা দে। বললাম, না। দেব না। - কেন দিবিনা? - আমি দিইনা। তাই। - তাহলে সিগারেট দে একটা। - নেই। - ধুর।  বলে একটা বিড়ি বের করল। তারপর ফুঁ দিয়ে বলল, দেশলাই আছে? - নাহ। - তুই কি রে! ঘাড় নাড়া পুতুল নাকি। কিছুই তো নেই। দেখি তাহলে একটা ছবি তুলে দে। ক্যামেরার শাটার সশব্দে তার কাজ করেছে জানাল। এমনিতে হিজরেদের আমি ভয় পাইনা। দেখলে শরীর খারাপও করে না। আমার সপ্রতিভ আচরণ ওকে মনে হয় অবাক করল। বলল, তুই কি রিপোর্টার? - না। তুমি তো মেয়েদের সালোয়ার পরেছ। তুমি কি মেয়ে? এবার সে ঘাড় নেড়ে চুপ করল। আমারও মনে হল প্রশ্নটা বাজে হয়েছে। দায়িত্বজ্ঞানহীন, অযথাই। তাই কথা পালটে বলল

নাগরিক দিনলিপি ৩

Image
পয়লা বৈশাখে গ্রীষ্ম ছুটি দিয়েছে শহরবাসীদের। সকালে লাল কৃষ্ণচূড়ার ছায়ায় ফুটপাথে হাঁটার সময় মৃদুমন্দ বাতাস। এখনও বসন্তকে যাওয়ার ছাড়পত্র দেয়নি বৈশাখ। ঘরে ফেরার পথে এটিএম-এ রসভঙ্গ। চার হাজার টাকা চাইতে একজোড়া দু'হাজারি নোট। একটায় আবার পেন দিয়ে লেখা! প্রায় বজ্রাঘাত। একটু পরেই দুই পাওনাদার আসবেন যাদের দিতে হবে চারশ' টাকা। ঘরে ফিরেই অগত্যা বেরোলাম বাজারের ব্যাগ হাতে। জোর করে কিছু জিনিসপত্র কিনতে, উদ্দেশ্য টাকা ভাঙানো। আলু, পেঁয়াজ, আদা, রসুন মিলে বিরাশি টাকা। চটপটে দোকানদার ছেলেটি বলল, তুমি আশি টাকাই দাও দাদা।   সোৎসাহে নোট বের করতেই বলল, এই খুলেছি দাদা, বাজার করে এসে দিও।   - আরে বাজার হয়েই গেছে। আর কিছু নেবনা। দেখনা, হয় কিনা।   ছোকরা বলল, না গো দাদা। তুমি পরেরদিন দিও। ফ্রিজে ভরতি মাছ। বাড়িতে প্রতিরোধ আসবে জেনেও গেলাম মাংসের দোকানে। এ আমার চেয়েও বুদ্ধিমান। লেখা টাকার বিনিময়ে, মাংস বিক্রি করে দিল তিনটি রঙ লাগা পাঁচশ' টাকার নোট। আপত্তি করতেই মৃদু বচসা। অবশেষে বলল, খুচরা নেই হ্যায় তো হাম কা করেগা। আপ কাল আকে দে দিজিয়ে। অর কোই চারা নেহি হ্যায়। চারা নেই বলেই ব

নাগরিক দিনলিপি ২

Image
চোখের সামনে ফুটপাথে চাওমিন বানাতে বানাতে এক কিশোর যুবক হল। আগে বানাত ওর দিদি। দুই বিহারি ভাই বোনের চেহারায় রুক্ষতার সঙ্গে সৌন্দর্য যেন বিনুনি করা ছিল। সেই কিশোরী আজ হয়ত নারী হয়ে তার নিজের সংসার সাজাচ্ছে। ছেলেটিও আজ এক নাগরিক, কর্মনিষ্ঠ ও পরিশ্রমী কারিগর -যে নিজের অজান্তেই দেশ বানাচ্ছে। মাঝে ফোন আসলে দূরের কোন আত্মীয়কে অভয় দেয় আজই টাকা পৌঁছে যাবে। অনেকের থেকেই মনে হয় এ দায়িত্ববান। এদের মধ্যে এক অসাধারণ গল্প ছিল আমি নি শ্চিত, কিন্ত খুঁজিনি। আমার অনুসন্ধিৎসা গল্পটার পেলব অংশে পৌঁছতে পারবে না বলে বিশ্বাস। ওদের পাশেই বেলুন বেচে এক মধ্যবয়সী পুরুষ। তার পাশে বসে থাকে দুই পথশিশু। বেলুনগুলো ফোলেনা, সেগুলো ওরা পায়। সন্ধেবেলা তার মধ্যে দু'একটা ফুলে উঠলে ওরা এত আনন্দ পায় তা আমি দামি রেস্তোরাঁতে নৈশভোজেও পাইনা। এই বেলুনওয়ালা একদিন দেখলাম ওদের কেউ না হয়েও বাদাম কিনে দিল। কিছু মানুষ হয়ত স্বভাবে অভিভাবক হয়। তারা সব ভালবাসাতেই অভিভাবক। আনন্দ পাওয়ার পথগুলো মনে সহজ, আমিই জট পাকিয়ে ফেলেছি। আরো কিছুদূরে বসে এক মুচি, তার পাশে এক পেয়ারাওয়ালি। সারা বছরই পেয়ারা বিক্রি করে, বারুইপুরে সারাবছ

নাগরিক দিনলিপি ১

Image
ছেলেবেলা থেকে শুনে এসেছি কিছু শুনতে না পারলে বলা হয়, তুই কি কালা? কিছু দেখতে না পেলে, তুই কি অন্ধ? বুঝতে না পেরে চুপ থাকলে, তুই কি বোবা? ভাল কিছু দেখতে পেলে অনেকেই বলেন, দেখলে চোখ ট্যারা হয়ে যাবে। সত্যি বলতে কি ট্যারা, তোতলা, কালাদের নিয়ে রসিকতা করারও বেশ প্রচলন আছে। বাচ্চাকাচ্চা নয়, বড়রাও বাদ দেন না। ডিভোর্সি, অবিবাহিত মানুষেরা তো রীতিমতো যাকে বলে 'খোরাক'। সমকামী বা লিঙ্গহীনরা তো মনুষ্যপদবাচ্যই না। সেই মানুষটার বেঁচে থাকাকে আমরা কতটা কণ্টকাকীর্ণ করলাম তা ভাবার সময় বা দায় আমাদের নেই। অথচ এই লিঙ্গহীন মানুষটির কাছে তার বাড়ির লোক এসে মাসের শেষে টাকা নিয়ে যান। সে আমাদের কাছে বিকট জীব, ঘৃণ্য, ব্রাত্য। বাড়িতেও বোধহয় অস্পৃশ্য, সবার মুখ পুড়িয়েছে জন্মে। বলাই বাহুল্য ট্যারা, কালা, বোবা, হিজরে এগুলো আক্ষরিক অর্থে কেউ বলেন না। তবে বলা উচিত কিনা সেই প্রশ্ন কি অপ্রাসঙ্গিক? আমাদের জীবন ও জীবিকা বহুলাংশেই গার্হস্থ্য কর্মীদের, বিশেষত নারীদের ওপর নির্ভরশীল। এঁরা প্রান্তিক মানুষ। খুবই দরিদ্র। আমি নিজে তেমন একজনের স্নেহে বড় হয়েছি। বড় কষ্টের জীবন ছিল তাঁর। আমি কিন্ত ওঁকে কিছ