যেতে যেতে::১৪ ...21 May,2020




কিছু সূর্যাস্ত মনে রয়ে যায়, কিছু আলাপ জীবনকে নতুন করে ভাবতে শেখায়, কিছু পথ এক সফরে শেষ হয়না, সে'সব পথ মিলে যায় জীবনের সঙ্গে। ফিরে আসার পরেও কিছু সফর মানুষকে তাড়া করতে থাকে। আমাকে এভাবেই তাড়া করে সাঁওতাল পরগণা'র লোহারডাগা আর নেতারহাট। 

সাঁওতাল পরগণা ... এক বিশাল ক্ষেত্র, আয়তনে যা ছিল কিছু দেশের চেয়েও বড়, বর্তমানে বৃটিশ আর ভারতীয়দের  আগ্রাসনে  নামই বদলে হয়ে গেল এক ছোট্ট রাজ্য- ঝাড়খণ্ড। আদিবাসীদের দেশে বেড়াতে আসার এক অদ্ভুত মাধুর্য আছে। এখানে কোন গন্তব্য নির্বাচন করে আসেন নি, তাই যেখানে যেখানে যাচ্ছেন সবই আপনার গন্তব্য। ঠগবাজেরাও আপনার চারদিকে ঘোরে না অথবা প্রচুর স্মারকের দোকানদার পণ্য নিয়ে পেছনে আসেন না। 

এই পথে লোহারডাগা পেরিয়ে বুধন সিংহের চায়ের দোকানে বসে শোনা আদিবাসী কৌশল্যার ভালুক সংহারের গল্প বলেছিলাম যেতে যেতে ৩-এ। সেখান থেকে বেরিয়ে রাস্তা একসময় ঘাঘরা বলে একটি জায়গা থেকে বাঁ দিকে নেতারহাটের দিকে চলে যায়। বর্ষাকালে সবুজের সমারোহে সবই উর্বর জমি বলে মনে হয়, তবে মানুষের মুখ ও শরীরী ভাষা ধনের অসম বণ্টনের কথাই উচ্চস্বরে বলতে চায়। দূরে ভেসে ওঠে নেতারহাটের পাহাড়, মাথায় মেঘের পাগড়ি। মাঝে মাঝে ছোটনাগপুর মালভূমির কাছিমপেঠা টিলা পেরিয়ে একসময় দেখা দেয় কোয়েল নদী। নেতারহাটের পাহাড়ের ঠিক আগেই কোয়েল বর্ষায় লালচে রং ধারণ করেছে। স্রোতের মধ্যে নদীর বুকে জেগে আছে কিছু বড় বড় পাথর। দু'পাশে শাল, মহুয়া, কেন্দ গাছের সারি। বিভূতিভূষণ তো বটেই, বুদ্ধদেব গুহ অবধি এখানে জঙ্গল দেখেছিলেন। আমি পেলাম না। 

কোয়েলের অদ্ভুত নিজস্বতা আছে। সে সমভূমির নদীর মতন প্রস্থে বা দৈর্ঘ্যে বড় নয়, পাহাড়ি নদীর মতন গতিও নেই। তবে  স্রোতের নিজস্বতা আছে, নিজের পছন্দের গাছপালা আছে, তার ওপর বয়ে যাওয়া বাতাসে কান পাতলে শোনা যায় একশ' বছর আগের আদিবাসীদের ‘উলগুলান’-এর গল্প(অর্থ 'প্রবল বিক্ষোভ), কোয়েলের একপাশে পাহাড় আর অন্যদিকে সমভূমি আছে, এখনও অভিমানের বয়স তাকে ছেড়ে যায়নি। তাই বাঁক নিতেও জানে।  গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে ছবি ভাল করে তোলা হলনা, তাই বৃষ্টি গায়ে নিয়ে কোয়েলের ওপর সেতুতে দাঁড়িয়ে একদল টিয়াপাখির খেলা দেখছিলাম। ড্রাইভারের ডাকে গাড়িতে উঠলাম, এখনও কিছু পথ বাকি। সন্ধের আগে পৌঁছেই হোটেল খুঁজতে হবে, চার দেওয়ালের নিরাপত্তায় কিছুক্ষণ ঘুম খোঁজার চেষ্টা। 

মানুষের দেখা খুব বেশি নেই পাহাড়ি ভাঙাচোরা পথে। একসময় দেখলাম শাল, পাকুড়, আম, পাইন, মহুয়ার জঙ্গল পেরিয়ে  মেঘের রাজ্যে চলে এসেছি। সম্ভবত ইংরেজদের লাগানো। নেতারহাটের পাহাড়গুলো যে এত উঁচু, সমভূমি থেকে বুঝতে পারিনি। পরে শুনলাম উচ্চতম অংশ সাড়ে তিন হাজার ফুট উঁচু প্রায়।  সারা বছর গরম পড়ে না, এমন জায়গা সাহেবদের তো পছন্দ হবেই। তারা নাম দিল ভালবেসে 'nature's heart', 'queen of Chotonagpur plateau' ইত্যাদি। পরে এই 'nature's heart' রূপান্তরিত হল 'নেতারহাট'-এ। আগে ছিল পালামু জেলা, এখন হয়েছে লাটেহার। সাহেবরা এখানে এসে নাসপাতিও চাষ করা শুরু করে, এখনও সরু পিচের রাস্তা নাসপাতি বাগানের মধ্যে দিয়ে চলে গেছে দেখা যায়। নেতারহাটে থাকার জায়গা বেশ কম, যে কয়েকটি আছে তা'ও বাঙালি পর্যটকদের কল্যানে ভর্তি। রাঁচি দেড়শো কিলোমিটার দূরে, তাই ফেরা যাবে না। এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলে রেখেছেন সন্ধে'র সময়ে সফর মুলতুবি রাখতে, মাওবাদী উপদ্রব এড়াতে। নেতারহাটে রবি-শশী লজ নামে এক হোটেল চালান রাজেন্দ্র প্রসাদ, তাঁর নিবাসও সেটি। তাই গিয়ে প্রথমেই আবদার করলাম, ঘর না থাকলে রান্নাঘরে বা বারান্দায় শুতে দিন আমাকে আর ড্রাইভারকে কিন্ত চলে যেতে বলবেন না। ভদ্রলোকের দুই পুত্র রাঁচিতে পড়াশোনা করছে, আর কিছু না হলে তাদের ঘরেই থাকতে দেবেন এমন একটা চিন্তা করে নিমরাজি হলেন। 

সানসেট পয়েন্টে নেতারহাটের সূর্যাস্ত ছিল ভাষায় বর্ণনা করার অতীত। দূরের অসংখ্য পাহাড় আর তার মাঝে বয়ে চলা কোয়েল ছিল মেঘের পর্দায় ঢাকা, মেঘের ফাঁক দিয়ে আসা কিছু সূর্যকিরণের আলোকস্তম্ভ সেই সবুজ উপত্যকায় অদ্ভুত আল্পনা তৈরি করছিল। সূর্যাস্ত দেখতে পাইও নি সেভাবে, মঘের জন্য। সে না পাওয়া পূরণ করে দিয়েছিল মেঘের আর নদীর রংবদল করার দৃশ্য।  আগে বলা নেতারহাটের ম্যাগনোলিয়া ভিউ পয়েন্ট বা সুইসাইড পয়েন্টে'র গল্পটা যদি কেউ না পড়ে থাকেন তাঁর জ্ঞাতার্থে জানাই, ম্যাগনোলিয়া ছিলেন এক সাহেবের মেয়ে। সে প্রেমে পড়ে এক আদিবাসী যুবকের ও যথারীতি তা জানাজানি হয়ে যায়। লোকে বলে ্তাকে নেতারহাট থেকে সরিয়ে দেওয়ার সময়ে সে গর্ভধারণ করেছিল। অনেক পরে সে যখন ফিরে আসে, তার আগেই সে আদিবাসী যুবক প্রাণ দিয়েছে ম্যাগনোলিয়ার বাবার হাতে। এই শোক নিতে না পেরে  "সুইসাইড পয়েন্টে" আত্মঘাতী হয়। যে গাছে লেগে তার মাথা চৌচির হয়ে যায়, সেটি তার বাবা পুড়িয়ে দেয়। সেই গাছের গুঁড়ি এখনও দাঁড়িয়ে আছে। ফেরার পথে দেখলাম এক মন্দিরের সামনে গ্রাম্য মেলা বসার প্রস্তুতি চলছে। দাঁড়ানো হয়নি সেই মেলাতেও, তাই সে আফশোষও রয়ে গেছে।

নেতারহাটে বড় মজা হল আপনি এখানে মোবাইল সিগনাল পাবেন না, বেশিরভাগ সময়ে কারেন্ট থাকে না। খুব অনুন্নত ও দারিদ্র্যপীড়িত। তাই সন্ধের পর একমাত্র বিনোদন হোটেল মালিক রাজেন্দ্র প্রসাদের সান্ধ্য বৈঠক। কিছু গ্রামের লোক নিয়ে চেয়ারে মৌজ করে বসে উনি প্রচুর গল্প করতে থাকেন। মাঝে মাঝে অন্ধকার রাতের বুক চিরে ভেসে আসে দূরে মাইনিং-এর গুম গুম করে শব্দ, আকাশ ঝলসে উঠছে বিদ্যুৎচমকে। কিছু লন্ঠন আর সোলার ল্যাম্প। ভদ্রলোকের গল্পগুলি পর্যটকদের কাছে অচেনা এবং আকর্ষনীয়। আবার প্রতি রাতে শ্রোতাও বদলায়। ভদ্রলোক নেতারহাটের মানুষ হয়েও সম্ভবত বলার ধরণে মুন্সিয়ানা এনেছেন বারবার বলে বলে। বলেন একসময়ে নেতারহাটে ঘুরে বেড়ানো বাঘ, ভালুক, হরিণ, শম্বর, অজগর বা বিষধর সাপের গল্প থেকে শুরু করে অবিভক্ত বিহারে নেতারহাটের সুবর্ণযুগ হয়ে আদিবাসীদের উপকথা সবই। 

একটি গল্প মনে রয়ে গেছে। অনেক অনেক বছর আগে একবার নাকি এক আদিবাসী গুণিন যাচ্ছিল রাস্তা দিয়ে, তার জ্বর এসেছিল বলে এক গাছতলায় শুয়ে ছিল। চোখ খুলে দেখে এক বিষধর সাপ। সে ফনা উঁচিয়ে তেড়ে আসছে, কিন্ত গুণিন তাকে ভয় পেলনা। উলটে বলল, আমি অসুস্থ কিন্ত তোমার ক্ষমতা থাকলে আমাকে ছোবল মেরে দেখাও। সাপ অনেক চেষ্টা করেও পারল না, তখন তাকে গুণিন ডাকল। বলল, কেন তুমি শুধুশুধু কাউকে কামড়াতে আসছিলে? আমি তোমাকে আশীর্বাদ করছি তোমার খাবারের কখনও অভাব হবে না, কিন্ত তুমি কথা দাও তুমি মানুষকে আর এমন করবে না। সাপ কথা দিল, গুণিন চলে গেল। সে কামড়ানো ছেড়ে দেওয়াতে কিছুদিনের মধ্যেই সবাই তা জেনে গেল। এক দুপুরে সেই সাপ যখন পোকামাকড় ধরে খাচ্ছিল, তাকে চেপে ধরল কিছু দুষ্টু ছেলে। তারা অত্যাচার শুরু করেছিল, সেই সময়ে রাস্তা দিয়ে ফিরছিল সেই গুণিন। সে এসে সবাইকে ভাগিয়ে সাপকে জঙ্গলে নিয়ে গেল। বলল, তুমি শুধুশুধু মার খাচ্ছিলে কেন? সাপ বলল, আপনাকেই তো আমি কথা দিয়েছি! গুণিন হেসে বলল, আরে বোকা আমি কি নিজের জীবন দিতে বলেছি তাই বলে? কমপক্ষে ফোঁস তো করবে তুমি!

গতকাল ছিল পনেরোই আগস্ট, স্বাধীনতা দিবস। পরদিন গাড়িতে ফেরার সময়ে রয়ে যাওয়া কাছিমপেঠা পাহাড়গুলোর দেখতে দেখতে ডিলান শুনছিলাম, আর ভাবছিলাম অভাগী ম্যাগনোলিয়া'র ব্যর্থ প্রেম কাহিনীর কথা। দেশকে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য কতশত এমন করুন ছবিই না দেখতে হয়েছে, তবে গিয়ে বিরসা মুন্ডা ফোঁস করেছেন একদিন। সেসব গল্প কোয়েলের জলে ধুয়ে চলে যাওয়ার আগেই প্রীতিলতা অস্ত্রধারণ করেছেন বা বারীন ঘোষ বোমা বাঁধা শিখেছেন। এখন সময় খনিজ সম্পদ লুটে নেওয়ার, ছোটনাগপুরের পাহাড়গুলি শেষ করে আধুনিক ভারত পূর্বঘাট পর্বতমালায় শ্যেনদৃষ্টি হেনেছে। আমরা মার্কিন মুলুকের রেড ইন্ডীয়ানদের নিয়ে চোখের জল ফেলি।এদিকে  দেশ স্বাধীন হয়ে একশ বছর হতে চলল, দেশের আদিবাসীরা  কিন্ত তাঁদের সম্মান পেলেন না। স্বাধীন ভারত হল লোভীদের চারণভূমি, বেনিয়া ভারত, সরকার সদর্পে প্রমাণ করে মানুষের 'দায়' তার 'ঘাড়ে' নেবে না। এই লাল মাটি কিন্ত তার রং বা চরিত্র বদলায়নি। পাহাড় হয়ত তার অপার উদারতায় মানুষকে ক্ষমা করে দেবে, মহাকালের নিরিখে কতই বা আয়ু তথা স্থায়িত্ব মানুষের! তবে ভারতের আদি বাসিন্দারা যেন আর একবার বুঝিয়ে দেন "উলগুলান" কি, ফোঁস করতে তাঁরা ভোলেন নি।

"আমি তো তাদের জন্য অমন সহজ মৃত্যু করি না কামনা।
আমাকে করেছে বাধ্য যারা
আমার জনক জননীর রক্তে পা ডুবিয়ে 
দ্রুত সিড়ি ভেঙ্গে যেতে আসতে নদীতে 
আর বনবাদাড়ে শয্যা পেতে নিতে
অভিশাপ দিচ্ছি 
আজ সেইখানে দজ্জালদের।" 

.........অভিশাপ দিচ্ছি, শামসুর রাহমান।

নেতারহাটের সফরে বড় আবেগতাড়িত হয়েছিলাম বারবার, তার কিছু রেশ এখানেও পাবেন। সত্যি বলতে কি আমি জলঙ্গীর পাশে বসেও, প্রায়ই কোয়েলের ওপর সেই সেতুতে ফিরে যাওয়ার রাস্তা খুঁজি।

দেবাঞ্জন বাগচী।

Comments

Popular posts from this blog

মনন..10th Feb 2019

নাগরিক দিনলিপি ১০ : 30 th Aug 2019

মনন...2nd Nov 2019