যেতে যেতে ৫ :: 22nd July 2018


-------------------
দু'পাশে সবুজ বনভূমি আর আগাছার মধ্যে দিয়ে চলে গেছে পিচের রাস্তা। বর্ষাকাল।  তার সঙ্গে কাটাকুটি খেলতে খেলতে যাচ্ছে এক ন্যারো গেজ রেললাইন। লাইন দিয়ে ট্র্বেন চলে না বহুদিন। দু'পাশে সবুজ, কিন্ত চাষ হয়না। মাঝেমধ্যে নিমগাছ আর আগাছা দেখে উত্তরবঙ্গের চা বাগান বলেই ভ্রম হয়। উত্তরবঙ্গীয় জীবন এ অঞ্চলের তুলনায় অনেক মসৃণ। এখানে প্রকৃতি মানুষের কাছে ত্রাস। হয় খরা নয় বন্যা। মাঝে কিছু নেই, কারন মাটির জলধারন ক্ষমতা প্রায় নেই। ছত্তিশগড়।

রায়পুর ছাড়িয়ে তেল নেওয়ার পর ড্রাইভার হিমেশ বলল কিছু খেয়ে নিতে। আগামী পেট্রোল পাম্প একশ' কিলোমিটার পেরিয়ে। শুনে আঁতকে উঠলাম। আজও এমন জায়গা আছে! অগত্যা সকালে চা সহ এক পেল্লাই বড়া নিয়ে গ্রাম্য দোকানে বসে গেলাম। শেষ পাতে জিলিপি আর গুলাবজামুন। এই বড়া কায়দা করতে আমার স্বাদগ্রন্থি আর স্বেদগ্রন্থি একজোট হয়ে প্রবল বাধা দিলেও খাবার না পাওয়ার ভয় তাদের নিরস্ত করল। সাময়িকভাবে। একটু পরেই ওরা খাঁটি প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল পাকস্থলীকে সঙ্গে নিয়ে। আরেকবার জেলুসিল এসে আমায় উদ্ধার করে। জীবনে এমন এক প্রেমিকা পেলাম না!

লালচে ধূলো-কাঁকরের উত্তেজনা নিবৃত্ত হয়েছে বৃষ্টির জলে। তারা শান্ত। মাঝেমধ্যে রাস্তা চলেছে শাল জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। শেষ হলেই দেখা দিচ্ছে ছোট ছোট পাহাড়। তাদের পিঠে ওঠা আর নামার মাঝে ছোট ছোট ঝর্না। লোকে বলে "নালা"। আর পাহাড়ি রাস্তাকে বলে "ঘাটি"। এই দুইয়ের প্রেমকাহিনীতে কখনও দূরত্ব আসছে, কখনও নৈকট্য। অতঃপর সঙ্গম। সেই সশব্দ  গোপন মুহূর্ত দাঁড়িয়ে দেখলাম। আপনিও দেখতে পারেন। পেছন ঘুরে গাড়ীতে ওঠার সময় পাহাড়ি ময়নার ডাক শুনলে উপেক্ষা করবেন না। সে এই রাজ্যের জাতীয় পাখি। আপনাকে স্বাগতম জানাচ্ছে শিস দিয়ে। কেশকাল ঘাটি এক অসাধারণ জায়গা। এখানে আগে কোনো ঔপনিবেশিক আধিপত্য ছিল কিনা জানা হয়নি। কিছু বাড়িঘর তার ছাপ বহন করছে। পেরিয়ে যাওয়ার সময়ে আপনাকে দু'দন্ড কাটিয়ে যেতে বলবে। ছেলেবেলার স্কুল যেভাবে ডাক দেয়।    

আমি চলেছি চিত্রকূট জলপ্রপাতের দিকে। বর্তমানের বস্তার, দান্তেওয়াড়া এবং কঙ্কার জেলা তৈরি হয়েছে ছত্তিশগড় তৈরির পর। পরে আবার বিভক্ত হয়ে কোন্দাগাও জেলা হয়েছে। এই সমস্ত জেলাগুলি মিলে বস্তার ডিভিশনের পরিচিতি, যা ২০০০ সালে মধ্যপ্রদেশের আরো ১৫টি জেলার সাথে ছত্তিশগড় রাজ্যের অংশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। 
চিত্রকূট এবং তীরাথগড় জলপ্রপাত দুটি জগদলপুরের কাছাকাছি অবস্থিত। জগদলপুরের কারুশিল্প বিশ্ববিখ্যাত। বস্তারে প্রচলিত উপজাতীয় ভাষাগুলি তিনটি মৌলিক গ্রুপে বিভক্ত - হিন্দি, দাবিড় এবং মুন্ডা। গাড়বা নামে এক ভাষা বিলুপ্তির পথে কারণ গাড়বা যে জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা, তাদের তরুণ সম্প্রদায় ধীরে ধীরে নিজেদের মধ্যে প্রতিদিনের যোগাযোগ এবং জেলার অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর জনগণের সাথে যোগাযোগের জন্য হিন্দি বা হাল্বি ভাষা ব্যবহার করে।কৃষি আগের শতকেই পড়ে আছে। এখনও দেখলাম কাঠের তৈরি লাঙ্গল। ট্রাক্টর দেখলাম না। খরিফ ফসলগুলি হল ধান, বিউলিডাল, অড়হর ডাল, জোয়ার এবং ভুট্টা। রবি ফসলের মধ্যে হল তিল, মুগডাল, সরিষা এবং ছোলা চাষ চলে।

আমার প্রিয় লেখক তারাপদ রায় লিখেছেন, শহর আসার অনেক আগে থেকেই তার গন্ধ পাওয়া যায়। আমিও দুপুর পেরিয়ে পেলাম। ড্রাইভার হিমেশের সময়ের হিসাব অব্যর্থ। আবার ক্ষিদে পাচ্ছে। রাস্তার ধারে অচেনা হোটেল। আমার টেবিলেই বসেছিলেন এক বৃদ্ধ। লাখন বাইগা। ইনি অভূজ মারিয়া উপজাতির। এই জাতীর খ্যাতির কারণ তাদের অনন্য জীবনাচরণ। বিবাহের আগেই সঙ্গমের অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য এঁরা অন্যের এবং একাধিকের সঙ্গে মিলিত হন বলে শোনা যায়। পারিবারিক সন্মতিতেই। কারন? শুনেছি এতে অতি নির্ভরতা জন্মায় না কারো প্রতি। ভদ্রলোক আমাদের ওইদিকেই যাচ্ছেন। হাতের নাগালে এমন মুখরোচক গল্পের উৎস পেয়ে কি ছাড়ে! নিয়ে নিলাম গাড়িতে। 

বারবার চেষ্টা করেও কথাটা পাড়তে পারলম না। অনেক বড় বয়সে। এক ছেলে মারা গেছে পুলিশের গুলিতে। তাকে রাষ্ট্র মনে করেছে রাষ্ট্রদ্রোহী। আরেকজন যোগদান করেছে সালোয়া জুড়ুমে। সে মাওবাদী মেরে বেড়ায়। পিতা দ্বিখন্ডিত। খানিকটা তো আমিও। রাষ্ট্রের সবই কি পছন্দ! কিন্তু বলতে গেলে আমিও মাওবাদী। অগত্যা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, চাচাজী একটা গল্প বলুন। আপনার শোনা কোন গ্রামের পুরনো গল্প।

বললেন, অনেক বছর আগে ছিল এক রাজা আর তার তিন কুমার। মারা যাওয়ার আগে বড় ছেলে নিল সব টাকাপয়সা, মেজ ছেলে নিল সব স্থাবর সম্পত্তি। ছোটর ভাগে থাকল খালি পশুপাখি। তাই নিয়েই সে খুশি। চলে যাওয়ার সময়ে রাজা বললেন আসল জিনিসটা নাকি তার জন্যই রাখা। রাজামশাই মারা গেলে শ্মশানে মাঝরাত্রে আনতে যেতে হবে। 

একদিন রাজার সময় ফুরাল। শেষকৃত্যের পর প্রথম রাতে সে গেল শ্মশানে। মাঝরাতে এল এক চিতাবাঘ। সে রাজপুত্রকে কিছু চাইতে বলল। রাজপুত্রের কিছু চাওয়ার নেই। তাই শুনে চিতাবাঘ বলল, আমার পিঠ থেকে একমুঠো লোম তুলে নাও। আমাকে দরকার হলে এর মধ্যে থেকে একটা লোম জলে দিও, আমি চলে আসব।

অনেকদিন কেটে গেল। রাজপুত্র ভুলেই গেছে। ইতিমধ্যে আরেক বড় রাজ্যের রাজার মেয়ের বিয়ে দেওয়ার সময় এসেছে। ঢেঁড়া দেওয়া হচ্ছে রাজকন্যা অমুক দিন তমুক পাহাড়ের মাথায় গিয়ে বসবেন। মহারাজ শিঙা বাজানোর পরপরই যে গিয়ে আগে রাজকন্যার সিংহাসন স্পর্শ করবে, রাজকন্যা তারই হবে। সেদিনই অসাবধানতায় একটি বাঘের লোম গিয়ে পড়ল ঘরে রাখা পাত্রের জলে। ব্যস! বাঘমামা হাজির। রাজপুত্রও হাতে চাঁদ পেল। বাঘ বলে দিল কাল সে এসে রাজপুত্রকে পিঠে করে নিয়ে যাবে পাহাড়ের উপর।

পরদিন সবাই হাজির। বড় আর মেজ রাজপুত্রও। শিঙা বাজতেই হঠাৎ কালো পোশাক পরে মাথায় বাইসনের শিং লাগিয়ে এক যুবক বাঘের পিঠে চড়ে হাজির। সে সবাইকে পেছনে ফেলে রাজকন্যার পাণিগ্রহণ করল। সবাই এমন বীরকে ধন্য ধন্য করছে। এমন সময়ে রাজপুত্র দেখল বাঘ চলে যাচ্ছে। সে গিয়ে বাঘকে ধন্যবাদ দিয়েই চমকে গেল। দেখল বাঘের পায়ে এক ঘুঙুর। যেটা ওর বাবা পরতেন। বাঘ যাওয়ার আগে আশ্বাস দিয়ে গেল, তাকে স্মরণ করা হলেই সে আসবে।বারবার। 

বাইসনের শিং এঁরা কিন্ত এখনও পরেন দশেরার সময়ে। বাঘ, ময়না, কচ্ছপ, মাছ আজও এঁদের ধর্মবিশ্বাসের অঙ্গ ও দেবতা। আমি যে বিষয়কে আদিরসাত্মক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখি, তা মারিয়াদের কোন দর্শন থেকে এসেছে বোঝার ক্ষমতা আমার নেই। আমার শহুরে কলুষিত মন তাকে স্পর্শ করতে পারবে, এমন আত্মবিশ্বাসও নেই। ওঁকে এক খাপরার দোতলা মাটির বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে চললাম আমার গন্তব্যে। আবার।

দেবাঞ্জন বাগচী।

#যেতে_যেতে_৪এর_লিঙ্ক
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=2059249460814349&id=100001879454450

Comments

Popular posts from this blog

মনন..10th Feb 2019

নাগরিক দিনলিপি ১০ : 30 th Aug 2019

মনন...2nd Nov 2019