যেতে যেতে ৪ : 7th July 2018


--------------------

সহপাঠী বলল - স্কুল নাই ডাকতে পারে। তার মানে আমরা যাবনা?

মাথা চুলকে বললাম- তাহলে তো স্কুল পালিয়ে যেতে হয়!

-ধেড়েখোকার ন্যাকামি দ্যাখ! পালাসনি নাকি কোনোদিন?  আমি তো এসব বিদ্যে তোর থেকেই রপ্ত করেছি।

অত:পর পোষাক পরিবর্তন। যাত্রা শুরু। রেলগাড়ির ড্রাইভারের কাছে আবদার করলাম তাঁর কামরায় চড়ে যাব। কিভাবে চালানো হয় দেখব। প্রথমে না না করলেও রাজি হয়ে গেলেন। গন্তব্য গোটা পঞ্চাশ কি.মি. দূরের আরেক মফস্বল। আমাদের স্কুল এক বিজ্ঞান প্রতিযোগিতায় যোগ দিয়েছে। তাতে কিসব মডেল বানিয়ে দর্শকমণ্ডলীকে মুগ্ধও করেছে। স্কুলে দেখতে গিয়ে বুঝছিলাম সেটা সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প বা কালিয়া দমন বা জনমেজয়ের সর্পসত্র যজ্ঞ বা হেবার পদ্ধতিতে এমোনিয়া উৎপাদন- সবই হতে পারে। তবে আমার জ্ঞানগম্যির বাইরে। আমাদের তাতে উৎসাহও নেই। বর্ষার দিনে অবৈধ ভ্রমনের নেশায় মাতোয়ারা।  দুজনেই।

বিনা টিকিটে যাওয়ার মধ্যেও এক রোমাঞ্চ। কাজেই টিকিটের পয়সা থাকলেই বা কাটি কেন। ড্রাইভার নরনারায়ণ চট্টরাজকে বলিনি সেটা। গন্তব্যে পৌঁছে দেখি বিজ্ঞান মেলা শেষ, দুপুরেই সব স্কুলের ছাত্র চলে গেছে। আমরা? চলেছি যত্রতত্র। দুপুরে ক্ষিদে সময় সারণি মেনে হাজির। চলে গেলাম এক নাম না জানা হোটেলে। ইলিশ মাছ সহযোগে ভাত, স্বাদে অপূর্ব। সহপাঠী পরিতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে বলল- আরেকদিন আমরা আবার খেতে আসব, হ্যাঁ?

এই হোটেল আমি অনেকদিন পরে এসে চেষ্টা করেও খুঁজে পাব না। পরে কোনদিন কোন ড্রাইভার আর রাজি হবেন না আমাকে তাঁর কামরায় নিতে। রূপকথা তো এমনই হয়। সব স্মৃতি খুঁজে কি পাওয়া যায়? কিছু কিছু দিন আসে, যেগুলো স্পর্শ করে যাওয়ার সময়ে বলে যায় - আমাকে ভুলতে পারবে না কখনও। আমাদের কেউ শেখায় না সেই দিনগুলি বুকভরে বাঁচতে। ভবিষ্যৎ চিন্তার সেদিন ক্যাজুয়াল লিভ।

ফেরার পথে ট্রেনে বসার জায়গা পেয়ে চোখ লেগে গিয়েছিল। সহপাঠীর খোঁচায় ধড়মড় করে ঘুম ভেঙে দেখি সে আলুর চিপ্স কিনেছে। চিপ্সের প্যাকেট সাদা কাগজের। ট্রেন  ফাঁকাই প্রায়। অপূর্ব সুস্বাদু আলুভাজা বিক্রেতা বৃদ্ধ সামনে হাসিমুখে বসে। সহপাঠী বলল- দাদু আর চিপ্স আছে? 

লাল শালুমোড়া বাক্স থেকে শেষ প্যাকেট বের করে বললেন-এই নাও। তোমার জন্যই রেখে দিয়েছিলাম।

আমি বললাম- আমি কাগজের প্যাকেটে চিপ্স বিক্রি করেন কেন?

- যখন কাজ শুরু করি তখন প্যাকেট ছিল না। আমার চিপ্স সবাই সাদা প্যাকেটেই চেনে। কাগজ তেল কিছুটা টেনে নেয়। আর শুনি নাকি প্লাস্টিক ভালও না। তা আমার সব রোজকার খরিদ্দার।  তাদের কি জেনে খারাপ খাওয়াব বাবা?

- আপনার বাড়ি কোথায়?

- সামনের স্টেশন।

- কতদিন এ কাজ করছেন?

- তা ধর বাহান্ন বছর। এইতো দু'বছর আগে আমাকে অন্য হকার আর ডেলি প্যাসেঞ্জাররা মিলে কত কি দিল! কাগজেও বেরিয়েছিল।এই দ্যাখ। এ নাও।

দেখলাম এক সান্ধ্য দৈনিকের প্রথম পাতার খবর- 'কর্মজীবনের পঞ্চাশ বছর পার করলেন এস আর দে'। সহপাঠী একবার নয় দু'বার পড়ল। অবাক চোখে বলল- আপনার বাড়িতে কে কে আছে?

- তোমার দিদা আর দুই ছেলে। এক ছেলে পোস্ট অফিসে কাজ করে। আরেকজন কলেজে পড়ায়। মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিয়েছি। জামাই শাড়ির ব্যবসা করে।

-আর আপনি এখনও আলুভাজা বেচছেন ট্রেনে? 

- ওমা। এই আলুভাজা বেচেই তো আমার সব। না এলে লোকে ছেলেকে ফোন করে আসতে বলে। ভাল তেল দিই। কারুর ক্ষতি হয়না। সকালে নিজেদের হাতে বুড়োবুড়ি আলু ভাজি আর বিক্রি করি। ছেলেরাও বারন করে। কিন্ত এই আমার পেশা বাবা। বাংলাদেশ থেকে ছয় বছর বয়সে একা একা এসে সবই করেছি আলুভাজা বেচে। আমার কি আলুভাজা বিক্রি না করলে এতকিছু প্রাপ্য ছিল বল?

কিছু একটা অসাধারণত্ব টের পাচ্ছিলাম এঁর মধ্যে। সেই 'কিছু'-টা যে কি আরো আট বছর পরে আমি জানব। যখন এই অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিশে যাবে বইয়ে পড়া Branding, packaging, customer centric approach, Total Quality Management, Quality of work life। বুঝেছি যিনি ভাবেন বই পড়ে ও শাস্ত্র রপ্ত হয় তিনি আহাম্মক। বই সংজ্ঞা ব্যাখ্যান করে। যিনি বোঝেন তাঁকে একজন বিশেষভাবে গড়েছেন।

এক বাউল উঠে লালনের গান ধরেছে। আমার চোখ জানালা দিয়ে এগিয়ে চলেছে রেললাইন ধরে। রেললাইনে মিশছে অন্য লাইন। সংযুক্ত লাইন চলছে নতুন পথে। এক জীবনে কত জীবন বাঁচে মানুষ? এক পথে কত পথের গন্ধ থাকে? রাজপথেও হয়ত গলির সোঁদা গন্ধ লেগে থাকে। আমরাই পাইনা। অসতর্কতায়।

দেবাঞ্জন বাগচী।

#যেতে_যেতে_৩এর_লিঙ্ক
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=2033914923347803&id=100001879454450

Comments

Popular posts from this blog

মনন..10th Feb 2019

মনন...2nd Dec 2019

যেতে যেতে ৫ :: 22nd July 2018