নাগরিক দিনলিপি ১০ : 30 th Aug 2019

নাগরিক দিনলিপি ১০
*********************

শীতের সকালে সূর্য ঝুঁকতে ঝুঁকতে উত্তরে সরে গেছে। সূর্য এই ক'দিন সকালে এক আধা পাকা-আধা টালির বাড়ির, টালির চালের তলা দিয়ে উঁকি দিতে পারে। এমনকি ক'দিন সেখানে রাখা স্টেটসম্যান কাগজের হেডলাইনও দেখতে পায়। 

লোহার জাল ভেদ করে আসা সূর্যরশ্মির সঙ্গে ভাগ করে স্টেটসম্যান কাগজের "ক্যাভিট" কলাম পড়ছেন এক বৃদ্ধ। সূর্যরশ্মি ক্যাম্বিসের ওপর পাতা কাগজে গা এলিয়ে দেওয়ার আগে চঞ্চল করে গেছে কিছু বাতাসে ভাসমান ধূলোবালিকে। পাশে মোটা কাঁচের গ্লাসে রাখা, সদ্য নামানো খেজুরের রস। কোন বাড়িতে মোরগ ডাকছে, মাঝে মাঝেই কিছু ফেরিওয়ালা গলিতে এসে হাঁক দিয়ে চলে যাচ্ছে। ওদিকে শীতের সকালেই সদ্য কেনা বেআব্রু একটি পুতুলের চুল আঁচড়ে দিচ্ছে একটি বাচ্চা মেয়ে। সেই মেয়ে ও তার পুতুল, দুজনের পোষাকই মায়ের উলে বোনা। তার বালক দাদা লুচির থালা কোলে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে চলেছে বৃদ্ধকে।

ইতিমধ্যে জানা গেছে পিতৃকূলের সবার জন্য এই বৃদ্ধ যা করেছেন তা শোধ করা যায় না। কয়েক দশক পরিবারের সমস্ত ভাই বোনের খরচ বহন করেও বাবা মাকে বাড়ি বানিয়ে দিয়েছেন। একবার বৈভবের জীবন ছেড়ে উদ্বাস্তু হয়ে আবার পরিবারকে বাড়িঘর করে দেওয়ার মধ্যে কৃতিত্ব অনেক। বালক চায় বড়জেঠু এখানেই থাকুন। সেই সঙ্গে আরো একটু থাকুক জেঠুর "ক্যাম্পা কোলা" বা "গোল্ড স্পট" খাওয়ানোর বিকেলগুলো। ওদিকে ফিরে যাওয়ার দিন আসছে। সে একদিন বলেই ফেলল, বড়জেঠু তুমি এখানে এসে থেকে যাবে কবে?

ফিক করে হেসে তিনি বললেন, তাতে কি তোমার ভাল লাগবে?
- হ্যাঁ।
- কিন্ত, আমি যে রোজ তোমায় কাগজ পড়াব বাবুয়া?
- পড়ব। আমার খুব ভাল লাগে তোমার সঙ্গে থাকতে।
- তাই! কিন্ত কেন?

বালক খানিক ভেবে বলল, মনে হয় আমাদের জন্ম তারিখ একদিন ওদিক বলে। আমরা তো একইরকম।
হা হা করে হেসে বৃদ্ধ বললেন, তাই কি হয়! আমার মত কখনও হতে নেই। তা ভালই যখন লাগে বলছ, তাহলে তুমি আমার সঙ্গে চল। যাবে নাকি?
- কোথায়? বোম্বে!
- আমি কিন্ত আর বোম্বেতে থাকিনা। আমি তো তোমার পিসির সঙ্গে থাকি সল্টলেকে।
- তোমার বাড়ি এখন কলকাতায়?
একটু চুপ করে বললেন বৃদ্ধ, না আমার বাড়ি নয়।
- তোমার বাড়ি কোনটা? এইটা না?
একটু আনমনা হয়ে এক বট গাছের পাতার দিকে তাকিয়ে বললেন, নাঃ। তাও নয়। আমার মনে হয় কোন বাড়ি নেই বাবুয়া।

                    *************

নবমীর দিন ভোরের লোকাল ট্রেন ধরে শহর থেকে মফস্বলে ফিরছি। চাকরির মাঝে দিন কয়েক বাড়ি যাওয়ার সুযোগ। চট করে উঠে সৌভাগ্যবশত জানালার পাশে জায়গা পেয়েছি, মুহূর্তে ট্রেন ভরে গেল। আমার চারদিকে অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের ভিড়। সবার গলায় একরাশ উৎসাহ। ওদের ঠাকুর দেখে বুকে কথা জমে আছে অনেক, সময় কম। তাই গলাও উঁচু আর বলার ধরন দ্রুত লয়ের। মেয়েরা খিলখিল করে হেসে উঠছে, দুই একটি ছেলের হাসি তখন ধাক্কা খাচ্ছে। হয়ত হৃদযন্ত্রের দুই একটি স্পন্দনও। দৃশ্যটা খুব বেশি সময় টানল না অপকৃষ্ট শব্দের জন্য। প্রাথমিক ভাবে সয়ে নিচ্ছিলাম, একটু পর হাঁসফাঁস করতে থাকলাম। এই ভাষায় সর্বসমক্ষে কথা বলিনি কখনও। ব্যারাকপুর এসে মুক্তি পাওয়া গেল। জানালা দিয়ে আসা বাতাসে এখনও হিমেল নয়, তবে মনোরম। উল্টোদিকের সিটে চোখ পড়ল, এক বৃদ্ধ বসে আছেন। মুখমন্ডল স্থির। বুক থেকে উঠে আসা কান্না চোখের জল হয়ে চোয়াল দিয়ে নেমে গলা ছুঁয়ে আবার শার্টের ভেতর দিয়ে বুকে চলে গেছে। যে কান্না কাউকে দেখাতে কাঁদা হয়নি, সে কান্না বড় গম্ভীর। আমার উৎসাহ এর গাম্ভীর্যকে স্পর্শ করতে পারবে না জানি, ওদিকে সামনে একজন পিতৃব্যপ্রতিম কাঁদছেন- সেটাও অবজ্ঞা করার জিনিস নয়। উসখুস করতে করতেই বললাম, কাকু ও কাকু.. আপনাকে বলছি।
থতমত খেয়ে বললেন, আমাকে! বলুন।
- আপনার শরীর ঠিক আছে?
- হ্যাঁ, ঠিক আছি। বলে আবার তাকালেন জানালা দিয়ে। যেভাবে মানুষ ভাল না থাকলে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
- একটু জল খাবেন?
- না না। আমি ঠিক আছি। 
- কোথায় যাবেন 
খানিক চুপ করে বসে বললেন, নবদ্বীপ।
- ও আচ্ছা আচ্ছা। ওদিকে তো বন্যা হয়েছিল, জল নেমেছে? 
- জানি না বাবা।
- ও, বেড়াতে যাচ্ছেন? 
- না এমনিই যাচ্ছি। আমার পূর্বপুরুষ ওদিকে থাকত। আমার কোন ঘরবাড়ি নেই। একসময় এক ছাপাখানায় কাজ করে বড় সংসার টেনেছি। এখন আর কিছু নেই। অসুস্থ হয়ে দেড়মাস ভুগলাম। বাড়ির লোকজন ভেবেছিল বাঁচব না। হাসপাতালে ভর্তি করে ডাক্তারকে বলেও গিয়েছিল- কিছু খরচ না করেই যদি বাঁচানো যায়। ডাক্তার ছেলেটাই জেদ করে বাঁচাল। আমাকে কিছুদিন আগেই ছাড়ার কথা কেউ নিতে আসে নি খবর পেয়েও।

এবার ব্যাগ থেকে বোতল খুলে জল খেলেন। তারপর বললেন, আমার বাড়ি এদিকে না। একবার সুস্থ হলেও শরীরে জোর নেই। ওষুধ কেনার পয়সা নেই। বারবার সুস্থ হব না, তাই নবদ্বীপে ফিরে যাই। ওখানেই বাপ ঠাকুরদার গঙ্গাপ্রাপ্তি হয়েছে। আর কারুর বোঝা হতে চাইনা।

আজ নবমীর পর কাল দশমী। চলছে ট্রেন। এগিয়ে আসছে আমার শহর। আমার সহযাত্রী হয়েছেন এক চলমান মৃত মানুষ। আমার উপচিকীর্ষা হেরে গেছে বাস্তবের সামনে। আমিও চুপ, আমার সহযাত্রীও। কিন্ত আমরা মানসিকভাবে কাছে এসেছি। মানুষ মুখ বন্ধ রেখেও কথা বলতে জানে। সে সত্যিই জীবজগতের ব্যতিক্রমী সদস্য।

আজ মনে পড়ে গেল, জীবনের শেষ অধ্যায়ে বড়জেঠু ফিরে এসেছিলেন তাঁর বানানো বাড়িতে শেষ কিছুদিন কাটাতে। বেশিদিন থাকতে পারেন নি। আবার ফিরে গেছেন। ছিলেন নৌ বিদ্রোহের প্রাক্তন সৈনিক ও পরে পেশাদার নাবিক। সংগ্রহে ছিল নানা দেশ ভ্রমনের অভিজ্ঞতা। জার্মান অধীনস্থ বুদাপেস্ট বা বলিভিয়ার ডাকটিকিট, মরক্কোর মার্বেল বা গ্রীসের বালিপাথরে তৈরি শিল্পকর্ম ইত্যাদি দুষ্প্রাপ্য সংগ্রহ আর অনেক অনেক গল্প। এক নিঃসন্তান সংগ্রাহকের সংগ্রহ ও সম্ভার তাঁর মৃত্যুর পর মূল্যহীন হল। ওঁর প্রাপ্য সম্মানের ভগ্নাংশও ফিরিয়ে দেওয়া হলনা। তখন আমিও জীবিকা খোঁজার যুক্তিতে কলকাতার পথে পথে। সময়ের অনেকটা পার্থক্য হয়েছে, আমার সত্যও বদলেছে তার অবস্থান। কাজেই সহযাত্রীর কোন কষ্টই আমি লাঘব করতে পারব না।

পরিচিত ট্রেন সফরে অনেকদিনের চেনা কিশোর বাদামওয়ালা, আজকে তরুণ। হাতে প্রায় অচেনা, চীনের খেলনা। ছেলেবেলা থেকে দেখা অন্ধ ভিখারি চেনা গান গাইছে, 

যখন তুমি ভবে এলে
তখন তুমি কি জাত ছিলে
কি জাত হবে যাবার কালে
সেই কথা কেন বলনা, ভোলা মন।

মানেটা কেন মিলছে না আজ!

                    **********

উৎসবের আগে কিছু আনন্দ কেনাকাটার বাইরেও মানুষকে ছুঁয়ে যায়। প্রবাসী দেশবাসী দেশে ফিরতে চায়। বড় শহরের বাসিন্দারা ছোট শহরে। ছোট শহরের কিছু মানুষ তার গ্রামে ফিরতে চায়। অফুরান আনন্দে প্রিয়জনের সাহচর্যে তারা নিজের উঠোনে বা বারান্দায় গল্প করে চারদিন অনেক কিছু ভুলে থাকতে চায়। হাটে/ বাজারে/ মলে/ ট্রেনে সে আমেজ দেখতে পাই। আমাদের উৎসবের অপেক্ষা চলে বাইকে বা বাইকের পিছনে বসে, ছাত্রছাত্রীদের পড়াতে পড়াতে, বাচ্চার ও গুরুজনের যত্ন নিতে নিতে, ট্রেনের কামরায়, কাগজের বিজ্ঞাপনে, অফিসে কাজের মাঝে দেখে নেওয়া পুজোর নির্ঘণ্ট দেখতে দেখতেই। এভাবে পুজোর দিন আরো কাছে আসে। হ্যান্ডবিল হাতে সবাই চাঁদা তোলে, সেজে ওঠে মন্ডপ, সেজে নেয় মেঘের দলবল, বাচ্চারা ক্যাপ ফাটানো বন্দুক নিয়ে মজা করে, কেউ নিজের বাড়িতেই বন্দী হয়ে পূজাবার্ষিকী পড়ে। কেউ উৎসবের ক'দিন নিজের বাড়ি খুঁজে পেয়েছে, আমি দেখলে বড় খুশি হব।

বড় সংসার আসলে কত বড় হয়? সংসার কি অনেকের, নাকি দু'জনের, একলা মানুষ কি সংসারী হতে পারে? বাড়ির সংজ্ঞা কি নিশ্চিত করে জানিনা। কোন থাকার জায়গা, এক মানুষের সঙ্গলাভের অভীপ্সা, বাপের বাড়ি, এক নদীর পাড়, নাকি কোন এক ঝিলের ধারে গাছের ছায়া, কে জানে! তবে নিজের জায়গা মনে হয় সেই জায়গা যেখানে মন ফিরে যেতে চায়। তাই মনে হয়, অসুস্থ মানুষকে তার পরিজনেরা আশ্বাস দেয় ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। যারা দূর থেকে উৎসবে বাড়ি ফেরে আবার তারা কর্মস্থলে ফিরে যায়, মন কি সঙ্গে যায়?

হয়ত ঘরে ফেরার ইচ্ছাই আমাদের অনেকাংশে বাঁচিয়ে রাখে। জীবন কি সফর, না নিজেকে খোঁজার জন্য অনুমোদিত সময়, নাকি বদলানো সত্যকে মেনে নেওয়ার অমোঘ শিক্ষা। আমার সন্ধান চলছে এখনও। কোথায় যেতে চাও মন আমার, ঠিক করে সেটাই জানলে না। কিসের তাড়া।

কি ভাবছ, আমার ভোলা মন!

Comments

Popular posts from this blog

মনন..10th Feb 2019

মনন...2nd Nov 2019