নাগরিক দিনলিপি ১১ : 26th Jan 2020

শীতের সকালে পাশের বাড়ির গাছপালার ফাঁক দিয়ে রোদ হাল্কা কুয়াশা পেরিয়ে আমাদের বাড়ির বাগানে হাজির নরম রোদ্দুর। মন দিয়ে দেখছি হাওয়ায় পাতা নড়ছে আর রোদের আল্পনাগুলো পাল্টে যাচ্ছে ক্যালাইডোস্কোপের মতন। আমার গায়ে সোয়েটার, কান ঢাকা।

চমকে উঠলাম পরপর বন্দুকের আওয়াজ শুনে। বাবা অভয় দিলেন - কুচকাওয়াজ শুরু হল। ছাব্বিশ জানুয়ারির প্রথম স্মৃতি অনেকটা এমনই। একটু বড় হয়ে যখন প্রথম নিজে দেখতে গেলাম তখন দেখলাম সে এক বিশাল আয়োজন। স্টেডিয়ামে তিল ধারণের জায়গা নেই। সাধারণ মানুষের সাথে হাজির জেলাশাসক, আরক্ষা অধীকারক, বিধায়ক আর সব স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা। আরক্ষা বাহিনী, রেডক্রস, স্কাউট, মনিমালার দল কুচকাওয়াজ করতে করতে চলে  যাওয়ার পর এক এক করে স্কুলের কুচকাওয়াজ। শৃঙ্খলিত ড্রামের তালে সবাই স্টেডিয়াম প্রদক্ষিন করার পর নানা রকম খেলা দেখানো শুরু হল। মাইকে বাজতে থাকল কদম কদম বাড়ায়ে যা, উর্ধ গগনে বাজে মাদল। প্রথম পুরষ্কার পেত গভর্মেন্ট স্কুলের মেয়েরা অনুষ্ঠান শেষে স্টেডিয়ামের সামনে রীতিমত ট্রাফিক জ্যাম। এ যে সময়ের কথা সেই সময়ে মফস্বল শহরে ট্রাফিকই ছিল না। তাই এক বাচ্চার কাছে সেও এক দেখবার বিষয়। 

কিছুদিন পর যখন ফুলপ্যান্ট পরতে শিখলাম তখন এক বছর নিজেই অংশ হলাম প্যারেডের। সেই বারেও গভর্মেন্ট স্কুলের মেয়েরাই আবার প্রথম হল। আমরাও অগ্রজ দাদাদের ট্র্যাডিশন অনুযায়ী নিজেদের দোষ দেখলাম না। সন্দেহ করলাম- কুচকাওয়াজ আসলে ফ্যাশান প্যারেড। স্কুল ছাড়ার পর দেখলাম ছাব্বিশ জানুয়ারি শুধুমাত্র কুচকাওয়াজের দিন নয়। সেদিন গ্যালারিতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম স্টেডিয়ামে গিয়ে বয়ঃসন্ধির সময়ে ছেলে-মেয়েরা নিজেদের মধ্যে আলাপ জমায়। কারুর প্রথম আলাপ, কেউ পূর্ব-পরিচিত। অনেকে আবার তাঁর জুড়িকে স্টেডিয়ামে খুঁজে বেড়াচ্ছে। মোবাইল আসার আগে কয়েক হাজার মানুষের মধ্যে কি করে মনের মানুষকে তারা খুঁজে বের করত তা ভেবে অবাক হই। আমার এমন উষ্ণ প্রজাতন্ত্র দিবস পালনের সৌভাগ্য না হলেও দেখতে ভালই লাগত। 

এই জুটিদের অনেকেই বেশ জনপ্রিয় ছিল। ছাত্রাবস্থাতেই তারা সাইকেল নিয়ে সদর্পে ও বড়দের তোয়াক্কা না করেই শহরের অলিগলি, নদীর ধার, মাঠ বা গাছতলাতে বসে তাদের জীবনের সেরা সময়টা কাটিয়ে এসেছে। কিছু জুটি ভেঙ্গে গেল, কেউ কেউ টিকে গেল। ছোট শহরে এদের ব্রেক আপের খবরে উঠতি ছেলেপুলের দল ব্যক্তিগতভাবে না চিনেও ব্যথিত হত, সেরা সুন্দরীর পলায়নের খবর বিশ্বাস করতে পারত না, আবার ঐসব জুটির বিয়ের খবরে আনন্দ পেত। এহেন একাত্মতা আমরা কি করে তৈরি করেছিলাম জানি না। 

মাঝে অনেক অনেক বছর বন্ধ ছিল প্রজাতন্ত্র দিবস কুচকাওয়াজ দেখা। পড়াশুনা, জীবিকা, বাস্তবের সঙ্গে লড়াই সেরে একবার ঠিক করলাম এবার যাবই যাব। বছর তিন আগের কথা, গিয়ে হতাশ হলাম। সেই প্রান পাচ্ছি না সাবধান-বিশ্রামে, বন্দুকের আওয়াজে সেই গুরুগম্ভীর ভাব নেই, জেলাশাসকের দাঁড়ানোর মধ্যে গা ছাড়া ভাব। আমার ক্লান্ত চোখও বিস্ময় খোঁজে না আর। তাকে সবকিছুকেই প্রশ্ন করতে শিখিয়েছি। এহেন রাসায়নিক বিবর্তনের পর সে যা দেখতে চাইব দেখবে কি করে। জনসংখ্যা অনেক কম ছিল। চোখে পড়ল একজোড়া চেনা মুখ। আমাদের থেকে চার-পাঁচ বছরের বড় এক জুটি বসে আছে। ছেলেটির মাথার চুল প্রায় সাফ, মেয়েটি বেশ মোটা হয়ে গেছে। এতদিন পর দেখে বেশ অবাক হলাম। এমন অসুন্দর সময়ে এই বয়সে একসাথে কুচকাওয়াজ! মনে পড়ে যাচ্ছিল এদের কোথায় কোথায় দেখেছি। তারপর মনে পড়ল ছেলেটির নাম রণজয়, এদের ব্রেক আপ হয়েছিল। ছেলেটি কোথাও বাইরে চলে গিয়েছিল। 

মন খচখচ করছে।নিজে বেশিরভাগ সময়ে শহরের বাইরে থাকি, যাকে এখন বলে Outsider আর কি। রণজয়ের পাড়ায় আমার এক বন্ধু থাকত, তার ফোন নম্বর জোগাড় করলাম। সে বলল আমি ঠিকই জানতাম। রণজয় শারজায় চাকরি করতে গিয়েছিল। মেয়েটির নাম ঊর্মিলা, ওর বিয়ে হয়েছিল। বাচ্চাও আছে, বর হাইওয়েতে বাইক এক্সিডেন্টে মারা গেছে। রণজয় বিয়ে করেনি, টাকাপয়সা জমিয়ে এখানে ফিরে এসে একটা দোকান করেছে। শুনে পুলকিত হয়েই সামলে নিলাম।

এদের প্রেমের আবহমানতার সঙ্গে নিজেকে এতদিন পর একাত্ম করাটাও অনুচিত, এর মধ্যেই ঊর্মিলার স্বামীর মৃত্যু হয়েছে। সেও নিশ্চয়ই আরেক করুন কাহিনী। তবে আজ আবার সকালে ওদের কথা মনে পড়লে দেখছি স্টেডিয়ামের ফ্রেমটাই মনে পড়ছে। সেই গাছতলার দৃশ্যটা মন মুছে ফেলেছে আবার। বড় হওয়া আমিটা যতই গুরুগম্ভীর বিষয় বোঝাই, ছোট আমিটা খালি ছুটির দিন পেয়ে আমোদেই থাকতে চায়।

দেবাঞ্জন বাগচী।

প্রজাতন্ত্র দিবসের শুভেচ্ছা।

Comments

Popular posts from this blog

মনন..10th Feb 2019

নাগরিক দিনলিপি ১০ : 30 th Aug 2019

মনন...2nd Nov 2019