নাগরিক দিনলিপি ১২ : চেনা সুখ, চেনা দুঃখ ..25th Feb 2020


*****************************************
রবিবারের সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে, আধ ঘন্টার দূরত্বে আমার জন্য অপেক্ষা করত দু'টি বিরাট দীঘি। শহর কলকাতার বুকে সে এক কল্পলোক। এপারে ঘাসে ঢাকা মাঠ। তাতে নানা ঋতুতে হতে দেখেছি চোরকাঁটা, কাশ, বুনো কুল, ঢোল কলমি বা কাল কাসুন্দির ঝোপ। মাঝে কচুরিপানায় খেলা করে কিছু জলমুরগি, পানকৌড়ি, বালিহাঁস আর বক। ওপারে কলাগাছ, কৃষ্ণচূড়া, খেজুর আর আগাছায় ঘেরা এক স্বপ্নের জগৎ। আরো দূরে মাথা তুলেছে অনেক নিউ টাউনের হাই রাইজ বাড়িঘর। দুই পুকুরকে আলাদা করে রেখেছিল এক পায়ে চলা পথ। সে পথ বর্ষার কিছুদিন বিশ্রাম নেয়, তখন দুই পুকুরের মিলনের সময়। ওপারের জনপদ থেকে মাথায় ঘোমটা দিয়ে নিউ টাউনে কাজে আসতেন বাড়ির মেয়েরা। ছেলেদের কেউ দাঁতে মাজন নিয়ে গবাদি পশু স্নান করাত, কেউ সব্জি বিক্রি করতে যেত। শহরের সীমানার মধ্যে জায়গাটি এতই গোপন ছিল, এপারে এক উৎসবের দিনে, আনন্দে আত্মহারা হয়ে, গানের সঙ্গে নাচতে নাচতে, তিন কিশোর আনন্দে বিবস্ত্র হয়ে জলে ঝাঁপ দিল। তারা বয়ঃসন্ধিতে, এতটা বাড়াবাড়ির জন্য প্রথমে প্রস্তুত ছিলাম না। পরে রাগ ছিল না। ভেবে দেখেছি অমন সুন্দর জায়গায় নির্জনতার মাহাত্ম্যে ওরা সেদিন শুধুমাত্র শেষবার শিশু হতে চেয়েছিল। আমিও একদিন এভাবেই ব্যাংবাজি খেলে ফেলেছিলাম ওখানে। তাছাড়া এর আগে এক কবিকেও আমরা ভালবেসেছি যখন তিনি লিখেছেন "মধ্যরাতে কলকাতা শাসন করে চারজন যুবক"।

আজ সকালে বহুদিন পর গিয়ে দেখলাম এপার উন্নয়নের কবলে। মাঠ বেড়া ঘিরে দেওয়া হয়েছে। বড় রাস্তা তৈরি হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রীর অনুপ্রেরণায় "হিডকো" ওই অংশ landscaping করছে। আগে তার মানে অসুন্দর ছিল। বেড়ার কাজ অর্ধ সমাপ্ত, আমি তার ফাঁক দিয়ে আমার পূর্বে পরিচিত জায়গায়, অর্ধেক অনধিকার প্রবেশ করলাম। সেখানে গড়ে উঠছে আধুনিক বিশ্রামাগার। গায়ে সিকিউরিটি সার্ভিসের ছাপ দেওয়া জ্যাকেট পরে সরল ও সুদর্শন এক নবীন। নাম নূর আলম। এত সকালে কাজে মন বসে নি, মগ্ন মোবাইলে গেম খেলতে। 

আলাপ জমিয়ে জানা গেল ওই পারও হিডকো অধিগ্রহণ করেছে। অনতিবিলম্বেই আধুনিক বিনোদন পার্ক গড়ে উঠবে। মনে প্রশ্ন আসছিল, গঙ্গাপাড়ে চটশিল্প কেন গড়ে উঠল তো জানলাম। পুকুরপাড়ে এত পার্কশিল্প কেন?

নূরের আগের প্রজন্মের চাষের জায়গা ছিল কাছেই রাজারহাটের জমি। সরকার দশ হাজার টাকায় কাঠায় যে জমি কিনেছিল, তা এখন বিকোচ্ছে পঁয়ত্রিশ লাখে। তার বাবাকে পুনর্বাসন দেওয়া হয়েছে ওপারের জনপদে, এক কাঠা জমিতে। তাতে মাথা গুঁজে আছে সাতটি প্রাণ। নূর আগে রঙ মিস্ত্রি ছিল, এখন সিকিউরিটি গার্ড হয়ে খুশি। ছিল "শ্রমিক", হল "চাকুরিজীবি"। তার মা-ও ফ্ল্যাট বাড়ির "কাজের লোক" হয়ে খুশিই হবেন। 

আশপাশে কান পেতে শুনলাম পরিস্থিতি ভয়াবহ। যাঁরা ওপারে হিডকোর এই নগরায়নের বিরুদ্ধে মামলা করতে চান তাঁরা উকিল পাচ্ছেন না। মুখ্যমন্ত্রীর অনুপ্রেরণাপ্রাপ্ত প্রশাসন ও আইনজীবীরা অন্য সব আইনজীবীদের শাসিয়ে রেখেছেন - এদের হয়ে কেউ মামলা না লড়ে। মানুষজন সিপিএমের প্রতি বিরক্ত হয়ে যাঁদের এনেছিলেন, তাঁদের শাসনে স্তম্ভিত। সংখ্যালঘুরা বি জে পি'র কাছে আশা রাখেন না। একজন বলেই ফেললেন - মানুষ যখন এমন পাপের সময় আর কারুর কাছে সুবিচার পায়না তখনই করোনা ভাইরাসের মত রোগ নেমে আসে। 
এঁরা কিন্ত দল, পার্টি, প্রশাসন, আইন সবার ওপর ভরসা হারিয়েছেন। একমাত্র উপায় ভগবান। পরিস্থিতি মানুষের মনে ধর্ম ভাব বা গোঁড়ামি আনলে কি করে দোষ দিই ! এই মানুষগুলোকে আবার হয়ত উচ্ছেদ করা হবে, আবার কোথাও এদের বসতি গড়তে হবে , "রহু চন্ডালের হাড়" উপন্যাসে জিপসিদের প্রধান পীতেম বারবার যেভাবে আরো পূর্বে বসত গড়তে যেত। 

হাঁটতে হাঁটতে সরে আসছি, দূর থেকে জায়গাটা আবার দেখলাম।তার গ্রামের দিকে পেছন করে নূর মোবাইলে গেম খেলছে। বুকটা ছলাৎ করে উঠল এক বছর আগের কথা ভেবে।

গত বছরের মার্চ মাসের শেষ দিনের কথা। সকালে অফিসে ঢোকার সময়ে অফিসের সিকিউরিটি গার্ড মুচকি হেসে দরজা খুলে দিলেন। বেরোনোর সময়ে দেখলাম মোবাইলে গেম খেলছেন, মুখ তুলে বললেন "গুড নাইট"। এই তথাকথিত "সাপোর্ট স্টাফ"দের আমাদের এক "অবৈধ" সম্পর্ক গড়ে ওঠে প্রায়ই। খাতায় কলমে এঁদের টিকি বাঁধা অন্য যায়গায়, আমাদের আরেক যায়গায়। প্রতিনিয়ত একসাথে কর্মস্থলে আত/দশ ঘণ্টা কাটাব। কাজ করব, পরিচয় গভীর হবে কিন্ত মন থেকে একে অপরের ওপর নির্ভর করতে পারব না। আউটসোর্স শব্দটি এক অলঙ্ঘ্য দেওয়াল রচনা করে। পরদিন সকালে দেখলাম এঁরা দলবদ্ধ হয়ে অফিসের সামনে চোখেমুখে একরাশ উদ্বেগ নিয়ে দাঁড়িয়ে। পয়লা এপ্রিলের সবচেয়ে বড় শিকার হয়েছেন এঁরা। এঁদের কোম্পানির সঙ্গে আমার অফিসের চুক্তি পুনর্নবীকরণ করা হয়নি। এঁদের আজ সকালে জানানো হয়েছে কর্মস্থলে না গিয়ে উক্ত অফিসে গিয়ে টাকাপয়সা বুঝে নিতে। আমাদের হেড অফিস বম্বে, এঁদের হেড অফিস হায়দ্রাবাদ। আমাদের ম্যানেজমেন্ট জানিয়ে দিয়েছে এঁদের পাওনাগণ্ডা মিটিয়ে দেওয়া হয়েছে।হাতের নাগালে কেউ এমন নেই যে ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করতে পারে। যোগাযোগ করলেন ওঁদের শ্রমিক সংগঠনে, তাঁরা পরের ফোনগুলো আর ধরলেন না। কেউ কেউ মিনমিন করে বললেনও সিটু নামটা। সেই সাহস কেউ জোগাড় করতে পারলেন না, কারন বামপন্থী শ্রমিক সংগঠনের সব বন্ধ তুলতে এঁদের ব্যবহার করা হয়েছে এতদিন। সেই সিটু এঁদের দেখবে এমন ভরসা নেই। একবার ভাবলেন আমাদের ঘেরাও করবেন। কিন্ত দেরি হয়ে গেছে তাতে, এসব অল্পবয়সী ছেলেরা দূর থেকে দুই বা তিনঘণ্টা ট্রেন চড়ে চাকরি করতে আসেন। তাই সারাদিন উদ্দেশ্যহীন ঘোরাঘুরির পর একসময় সন্ধে ঘনিয়ে এল, ফেরার শেষ ট্রেন ধরলেন একে অপরকে বিদায় জানিয়ে। মোবাইলের গেমে নকল শত্রুর সঙ্গে সাপ লুডো খেলতে খেলতে চেনা গেলনা নকল শত্রুকে। পরদিন সকালে দেখলাম নতুন কোম্পানীর নতুন জামাকাপড় পরে আরেক অল্পবয়সী যুবক। মুখের হাসিতে মফস্বলের গন্ধ কাটেনি, হয়ত এটাই প্রথম চাকরি। সেইদিন সন্ধেবেলা ফেরার সময়ে দেখলাম এই ছেলেটিও গেম খেলছে মোবাইলে।

কাজেই হিডকো'র উন্নয়নের মাহেন্দ্রক্ষনে নূরের মোবাইল হাতে ছবি আমার কাছে চেনা সুখ, চেনা দুঃখ। যেখান থেকে দাঁড়িয়ে ওকে দেখছিলাম, সেখান দিয়ে চার লেনের প্রশস্ত রাস্তা তৈরি হচ্ছে। যে সিন্ডিকেটের ছেলেরা বরাত পেয়েছে তারা বলছে একগাড়ি বালি আনার জন্য কত জায়গায় পয়সা খরচ করতে হয়। চলাফেরায় বেশ সাহসী ভাব, রাষ্ট্রের ও প্রশাসনের মদতে এরা এক ছোট অংশের জমিদারি পেয়েছে। কিছুদিন এদের ইচ্ছাই হবে আইন, তারপর সে ব্যবস্থা "চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত" হওয়ার আগেই এদের সরিয়ে দেওয়া হবে। 

আমার এই নীরস শহরের বুকে একটুকরো স্বর্গ শেষ হয়ে গেল। কল্পনায় দূরে তাকিয়ে দেখছি, ততদিনে এই রাস্তা চওড়া হয়ে মিলবে দিল্লী রোডে। কিছুদূর গিয়ে ডানদিকে বাঁক নিয়ে সেই রাস্তা ধরে চলে যাওয়া যায় অজয়ের পাড়ে। যেখানে বালির খাদান থেকে প্রশাসনের মদতে বালি তুলছে বালি মাফিয়ারা। তাদেরও বালি শেষ হয়ে আসছে, ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে অন্য কোন গ্যাং।সবাই কাউকে শত্রু ভেবে কোন না কোন যুদ্ধে মত্ত।আসল শত্রু চিনতে পারছে না। এরই ফাঁকে এগিয়ে চলেছে নগরায়ন দুর্বার গতিতে। 
"আমি যাই তারি দিন-পঞ্জিকা লিখে"।

 দেবাঞ্জন বাগচী।

Comments

Popular posts from this blog

মনন..10th Feb 2019

নাগরিক দিনলিপি ১০ : 30 th Aug 2019

মনন...2nd Nov 2019