যেতে যেতে ২: 25 th Nov 2017


-------------------
দু'পাশে ধূ ধূ মরুভূমির মধ্যে দিয়ে ছুটে চলেছে মধ্যপ্রাচ্যের সুপারফাস্ট হাইওয়ে। সবুজ বলে যে কিছু নেই তা নয়। আছে কিছু কাঁটাঝোপ আর বাবলা-জাতীয় গাছ। বাতানুকূল বাসের পর্দা সরিয়ে, আমার চোখ পেরোনোর চেষ্টা করছে দিকচক্রবাল। মনে পড়ে যাচ্ছে 'লরেন্স অফ আরাবিয়া' ছায়াছবির দৃশ্য। এমনই দিগন্ত থেকে একটি কালো বিন্দু দেখা যাচ্ছিল। সেটাই বড় হতে হতে দেখা দিল এক দুর্ধর্ষ ঘোড়সওয়ার, শরিফ আলি। কি দুর্দান্ত অভিনয় করেছিলেন ওমর শরিফ। সেই শরিফ আলির ভূূূমিকায়।

ওদিকে সূর্যদেব অস্ত যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। একটিও মেঘ এখানে বিদায়বেলায় ওঁকে টা টা করতে আসে না। সময়মত সূর্যকে রঙ বদলে লাল হয়ে যেতে হয়। তারপর জৌলুস হারিয়ে একসময় সে মিলিয়ে যাবে বালিয়াড়ির পেছনে। দিগন্তরেখার  এত কাছ অবধি সূর্য দেখা যায়না আমাদের দেশে। তারপরই বইতে থাকে ঠান্ডা বাতাস। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। আধঘণ্টার ফারাকে মনে হয় জ্যাকেট থাকলে ভাল হত। পাহাড়, নদী, সমুদ্র, অরন্যের মতন মরুভূমিরও এক সৌন্দর্য আছে। শুধুমাত্র চোখ নয়, ষষ্ঠেন্দ্রিয় দিয়ে তাকে অনুভব করতে হয়। এক খেজুরের ব্যবসায়ী বশির বলছিল, এ সৌন্দর্য সবার কাছে ধরা দেয় না। এই কাঁটাগাছগুলোই নাকি জ্যোৎস্নারাতে ফিসফিস করে জিনপরিদের সাথে গল্প করে।

গাড়ি থেকে নামার সময় এসে গেছে। চলে এসেছি ডেসার্ট ক্যাম্পে। সন্ধেবেলা বেদুইনদের নাচ, গান ও স্টান্ট। বলে রাখা ভাল, তেল আবিষ্কার হওয়ার পর থেকে আমিরাতের লোকেরা আর এসব করে না। একসময় খুব কষ্টের দিন গেছে। একশ' বছর আগে - গোটা আরব তখন বলতে গেলে ফাঁকা মাঠ, স্থানীয় গোত্রগুলো নিজেরা নিজেদের এলাকা ভাগ করে নিচ্ছে। এক সময় প্রবল প্রতাপের সাথে আরব শাসন করা অটোমান খেলাফতের দিন ফুরিয়ে আসছে। আর আরব বিপ্লবের ডাক দিয়ে হাশেমী নেতা হোসেন ঘোড়া হাঁকিয়ে বেড়াচ্ছেন হেজাজের মরুভূমির ভেতর। দিন বদলেছে। তরল সোনার বৈভবে তারা এখন তেল পুড়িয়ে জল বানায়। সন্ধ্যার আসরে মঞ্চে আসে উত্তর আফ্রিকান আরব বংশগত ছেলেরা আর টুকরো রাশিয়ার মেয়েরা। এক সুুুুপুরুষ আগুন নিয়ে খেলা আর 'তানাউরি' ডান্স দেখানোর পর মঞ্চে এল আজকের 'সেরা আকর্ষণ ' এক ডানাকাটা পরির নৃত্যানুষ্ঠান।

যেমন লম্বা, তেমন মেদহীন চেহারা, প্রায় হাঁটু অবধি চুল, মুখ এতই সুন্দর যেন ঈশ্বর বহু বছর সময় নিয়ে তৈরি করেছেন। মুহুর্তেই তার চটুল নাচ আর শরীরী বিভঙ্গে কয়েকশো দর্শক মাত। আমার চোখ আটকে ওর পেটের কাটা দাগে। সিজারিয়ান পদ্ধতিতে মা হওয়ার এই স্মৃতি ও সারাজীবন বইবে। আকাশপাতাল ভেবে চলেছি। ওর যদি একটা মেয়ে থাকে? সে যদি দেশে হোস্টেলে পড়াশুনো করে? হয়ত বা সেই মেয়ে জন্মাতে গিয়েই মারা গেছে, নাকি বিক্রি হয়ে গেছে! 

মরুপদ্মের সুবাসও সবাই নিতে পারেনা। যেমন এই আমি। আরও একবার প্রমান পেলাম।

***************************

আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দেশে ফেরার বিমানের অপেক্ষায় বসে আছি। মোবাইল চার্জ দিতে গিয়ে চোখ আটকে গেল পাশে বসা বিদেশিনির মুখে। আমার পাশেই এ তো সেই মরুপদ্ম! না ভুল নেই। রূপটান না থাকায় চোখের তলার কালি বেরিয়ে পড়েছে। বোতলের জলের শেষ বিন্দুও ঢেলে খাচ্ছেন। পানীয় জল বেশ দূরে। বোতল বাড়িয়ে দিতে জল খেয়ে কৃতজ্ঞতা জানালেন। নাম বলাতে জানালেন নাম লুডমিলা আকিলোভা। বাড়ি কাজাকিস্তান। আর কিছু প্রশ্ন করার আগেই ছুটতে ছুটতে এল এক ফুটফুটে রাজকন্যা। ডাকনাম তার মিশা, ভালনাম রুডমিলা। পেছনে অনেকগুলো সুটকেস নিয়ে এক অল্পবয়সী যুবক। চমকে উঠলাম, এ তো সেই ছোকরা! যে আগুন নিয়ে খেলা দেখাচ্ছিল। হাত মিলিয়ে জানলাম ওরা নাকি এখানে 'চাকরি' করত। 'চাকরি' করতে করতে আলাপ, প্রেম ও দিন পনের আগে বিয়ে। ওর নাম আমের বিন তালাল। বাড়ি প্যালেস্টাইন।  চাকরির কন্ট্রাক্ট শেষ, তিনজনে সংসার পাততে চলল কাজাকিস্তান।

ওদের ফ্লাইটের সময় আসন্ন। বিদায় জানিয়ে তিনজন চলল ট্রলি নিয়ে ঘোষিত গেটের দিকে। হাত নাড়লাম। একসময় মিলিয়ে গেল ওরা। হাঁফ ছেড়ে, মনে মনে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানালাম।

Comments

Popular posts from this blog

মনন..10th Feb 2019

নাগরিক দিনলিপি ১০ : 30 th Aug 2019

মনন...2nd Nov 2019