নাগরিক দিনলিপি ১৩ : ভাইরাসের সঙ্গে যুদ্ধ...21st March 2020


***************************************

"মোক্ষম আঘাত যারা করেছিল
তারা হয়ত জানে না,
মোক্ষমের প্রয়োজন নেই,
শুধু আঘাতই যথেষ্ট,
যথেষ্ট আঘাত।"

সুযোগ পেলেই তারাপদবাবু কোথায় কোথায় চলে যান, ওঁর লেখার মধ্যে আমাকেও বগলদাবা করে নিয়ে। উনি আজই আবার এক কবিতায় এই আঘাতের কথাই তুললেন।

সারা বিশ্বকে নাচিয়ে বেড়াচ্ছে করোনা ভাইরাস। আমরা এক অসম যুদ্ধে লড়ছি। এখানে সব যুদ্ধাস্ত্র বিফল, ধর্ম হার মেনেছে, উগ্রপন্থীরা বেকুব, গ্লোবালাইজেশনের মোটামুটি লাইগেশন হয়ে গেছে, অস্ত্র বেচা দেশগুলোও ঘর সামলাতে ব্যস্ত। উপায় একটাই - অন্তরীন হয়ে বসে থাকা, আর আকাশ পাতাল ভাবা। আপাতদৃষ্টিতে শাটডাউন দরকার বলে মনে হচ্ছে, কিন্ত আমরা কি সেটা হজম করতে পারব?

পাকিস্তানে গতকাল এক কোয়ারান্টাইন কেন্দ্র পুড়িয়ে দিল এলাকার উন্মত্ত জনতা, অবশ্যই রোগী সমেত। সেও আমাদের অনেকেই চান - "এ যদি শালা চীন হত"। করোনা রোগীরা সব মারা গেল, আমার বাড়ির কারুর কিছু হল না, আঘাত করলাম না, কিন্ত চাইলাম মারা যাক। সম্প্রতি আমার এক পোস্টে আমি এক বিপন্ন রোগীর সুস্বাস্থ্য কামনা করে মানুষের বিরাগভাজন। অবিশ্বাস করছেন কি কেউ, আমি স্ক্রিনশট পাঠাব মেসেজে। আমার প্রতি তীব্র হতাশায় কয়েকজন বন্ধু কিছু পোস্ট করেছেন, তার কমেন্টে তাঁদের প্রিয়জনেরা লিখেছেন- "he should be slow poisoned", "ওই তিনজনকে ক্যালাতে ক্যালাতে মেরে ফেলা উচিত", "লন্ডনে খায় আর এ দেশে এসে হাগে যারা তাদের গুলি করে মারা উচিত"। আমরা মৃতদেহ দেখতে চাই, সম্ভবত সে ইচ্ছা অপরাধ নয়। তবে রোগী মারা গেলে, বলব পোয়েটিক জাস্টিস। জাস্টিস খুব উপযুক্ত শব্দ এখানে। সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে আমরা তিন সেকেন্ড সময় দিই একটি নিউজ ফিডকে। ঠিক বা ভুল কিছু একটা একপাক্ষিক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি। আমাদের জ্ঞান-বুদ্ধি-চেতনা স্মার্টফোনের ফোর জি'র সংস্পর্শে এসে দুর্বার গতিবেগ লাভ করেছে। তাই ফল চাই ম্যাগি নুডলস সুসিদ্ধ হওয়ার আগেই।

এভাবেই চলছিল জীবন, বাদ সাধল করোনা ভাইরাস। তাকে তো আমরা মারতে পারব না ! কিন্ত আমার আদালতের রায়ে কেউ সাজা পাবে না, তা তো হয়না। আমার দায় নেই। তাই দায়ী চীন বা আমেরিকা, ইতালি, বা লন্ডন, বা ওখানে কর্মরত এ দেশের সফল নাগরিক। এই রোগ আনছেন অপেক্ষাকৃত ধনীরা অবশ্যই, কিন্ত ওঁদের থেকে এতদিন তো আমরা foreign remittanceও পেয়েছি। তাতে কি দেশের আর্থিক লাভ হয়নি? আচ্ছা, আমাদের ঘরে থাকতে হচ্ছে কি রায় দিতেই?

আমরা কারা ! আসি প্রথম বর্গের কথায়। যাঁদের জন্য দরকার শাটডাউন।

সন্ধেবেলা দমদমের পথে আমি অবাক। না "antenaতে সারি সারি কাক" মোটেও বসে নি। রাস্তায় মানুষ আর গাড়ির ভিড়। বিরিয়ানির দোকানে জটলা, চায়ের দোকানে আড্ডা, জামাকাপড়ের দোকানেও বিকিকিনি চলছে, ফুটপাথে গোত্রহীন মাস্কের ব্যাপারির সামনে উপচানো ও ভয়াবহ ভিড়, কেক শপ, ক্যাফে কফি ডে, মাছের বাজার জনবহুল। মানুষ সামনে অঢেল ছুটির আনন্দে পিকনিকের মেজাজে। স্থান- আগ্নেয়গিরির শিখর। যারা ফেসবুক ভরিয়ে দিচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী আর প্রধানমন্ত্রীর "সামনে থেকে" নেতৃত্ব দেওয়ার দক্ষতায়, তাঁদের আমি সকলকে নিজের পশ্চাদ্দেশের দিকে অতী্ব মনোযোগ সহ আগামী কিছুদিন দৃকপাত করতে অনুরোধ করব। কিছুদিন পর ওই নেতৃত্ব কোন অরক্ষিত ও স্যানিটাইজারের সুগন্ধ বর্জিত স্থান খুঁজবে কিনা। তখনও ওঁরা ভিডিও কনফারেন্স করেই কিন্ত কাজ সামলাবেন, আপনার পশ্চাদ্দেশের যা হওয়ার হয়েই যাবে। দেশের মানুষকে সাত দিন কমপক্ষে ঘরে থাকার কথা না বলার দায় ওঁরা নেবেন না।

আমার মত কিছু "মূর্খ"/"irresponsible" ছাড়া আর সকলেরই মুখে মাস্ক। আমি ব্যক্তিগতভাবে এই রোগ নিয়ে খুব চিন্তিত। বহুবার হাত ধুচ্ছি, মানুষজনকে দূরে থাকতে বিনীতভাবে অনুরোধ করছি। যা দেখলাম মাস্ক নিয়ে সরকার বা চিকিৎসকরা খুব জোর দেন নি। আমিও তা কেনার লাইনে নেই। ভয়ও কম, কারণ আমার উদ্দেশ্যে এক প্রিয়জন নিধান হেঁকেছিলেন বছরকয়েক আগে, আমি মৃত্যুর সময় মুখে জল পাব না। আমিও শোনার পর থেকেই মানসিক প্রস্তুতি রেখেছি, মঞ্চও তৈরি, করোনাও নাকি বিশ্বের ষাট শতাংশ মানুষের শরীরে বাসা বাঁধবে। যেটা খারাপ লাগছে তা হল "ভাগাড়ের মাংস" হজম করে অর্জিত সাহস। ভাগাড় কাণ্ডের পর আমাদের নাকি কিছুই হবে না। এত লোক রাস্তায়, এত গাড়ি প্রথম বর্গের মানুষের ভিড়ে ছয়লাপ - "এত সব যাচ্ছে কোথায়" !

দ্বিতীয় বর্গের কিছু মানুষজন আবার যাচ্ছেনও না। এঁরাই আসল ভাইরাসের শিকার- মনুষ্যত্ব আক্রান্ত। করোনা নিয়ে বাল()খিল্য মিম ও জোকস করে চলেছেন। একটা নতুন কিছু দেখতে চলেছি। এ যেন হলিউডের ডিসাস্টার সিনেমা। একটু পরেই হিরো এসে আমাদের মুক্তি দেবে। কি পৈশাচিক আনন্দ! যেমন পাওয়া যেত বন্যার সময়ে, বিশ্বযুদ্ধের সময়ে বা নিরোর বীনার আওয়াজে। আর আছে ভয়, ঘৃণা আর Trolling। মনের ঝাল মেটালাম বাছা বাছা বাক্যবাণ ঝেড়ে বা আরেক হুজুগে বিজ্ঞের মত শেয়ার করে। সকালে উঠে ব্রাশটা ঠেলে আক্কেল দাঁত অবধি মাজতে মাজতে মনে পড়ল, হ্যাঁ! কাল একটা রায় দিয়েছিলাম বট! আসামীর ভার্চুয়াল ফাঁসি হল কি না দেখি। তারপর ফোন খুলেই দেখি নতুন কিছু ঘটে গেছে আমাদের অলক্ষ্যে। এতে আমার ওপিনিয়ন নেই !আবার নতুন কক্ষে সকালের বিচারসভা।

হুমায়ুন প্রায়ই লিখতেন "প্রকৃতি রহস্য পছন্দ করে"। কোন রহস্যে এঁদের বিবর্তন শাখামৃগ থেকে মানুষে মাত্র এক প্রজন্মের মধ্যেই হয়ে গেল তা রহস্য বই কি। এঁদের জন্য আমার মনে হচ্ছে দরকার Ignorance & social isolation । দয়া করে গড্ডলিকা স্রোতে দেখামাত্র "শেয়ার ও লাইক করে অন্যকে দেখার সুযোগ করে দেবেন না"।

তৃতীয় বর্গের মানুষেরা কিছু অসহায় মানুষ। বৃদ্ধ, একাকী বা দম্পতি যারা সন্তানহীন বা সন্তানেরা দূরে বা দেখেনা। যে আশীতিপর মহিলা বয়সের ভারে নুব্জ হয়ে লাঠিতে ভর দিয়ে ব্যাংকে রুগ্ন স্বামীর পেনশন তুলতে যান ও ক্যাশিয়ারের ধমক খান। আর কয়েকদিন। তারপর কি হবে জানলে প্রথম বর্গের মানুষেরা একটু হলেও যত্ন নিতেন তাঁদের জীবনাচরণে, যেন দরকার ছাড়া বাড়ি থেকে বেরোতে না হয়। তাঁদের মাধ্যমে ভাইরাস বিস্তার লাভ করছে। এঁদের দরকার আপনার মতন পড়শিদের উষ্ণতা, পাশের বাড়ির মাসিমাকে আরেকবার দুর্গাপুজোটা দেখানো কি আমাদের কাজ নয়?

চতুর্থ বর্গে থাকবেন শ্রমিক, কৃষিজীবি ও দৈনিক মজুরিতে চালানো মানুষগুলি। কোনদিন কৃষ্ণনগরের চিত্রমন্দিরের কাছে বা কলকাতায় দমদম স্টেশনের পাঁচ নম্বর প্লাটফর্মের আগে দাঁড়িয়ে থাকা দৈনিক শ্রমিকদের দেখেছেন? সকাল ন'টা বাজলে তাঁদের চোখ দেখেছেন? ন'টা বেজে গেল সারাদিনের কাজ জোগাড় না করার ভয়? এঁদের দরকার রাষ্ট্রের নিরাপত্তা। ন্যূনতম কার্বহাইড্রেট আর প্রোটিন পেলেই এঁরা কিন্ত আরেকটা বিপদ উতরে দেবেন। না পারলে আমার আপনার সকলের উচিত সঠিক সরকারের খোঁজ করা।

পঞ্চম বর্গে থাকবেন এই ভদ্রমহিলার মতন ফুটপাথবাসী, ভবঘুরে ও ভিক্ষুকেরা। ছবিটা অস্পষ্ট, এদের ভবিষ্যৎও। সাতদিন পথঘাট বন্ধ থাকলেই যাঁদের জীবন সংশয়। তার চেয়ে বেশি হলে চল্লিশের দশকের মন্বন্তরের মতন রাস্তাঘাট ছয়লাপ হয়ে যাবে এঁদের মৃতদেহে। এঁদের দরকার আপনার আর্থিক দান। যে যা উদ্বৃত্ত টাকা আয় করেছেন এঁদের দান করুন। সেই টাকায় এঁদেরকেও কিছু চাল ডাল জমাতে দিন। হাতে সময় কমে আসছে, আপনার দানেই এঁরা বেঁচে আছেন, তাই গাড়ি থামিয়ে দান করুন। এক সহৃদয় অটোচালক কাল রাজি হয়েছেন এই মাসিমাকে দেখে আমার অনুরোধে গাড়ি থামাতে, আপনি বললেও গুরুত্ব বুঝে হবেন বলেই আমার বিশ্বাস। আমি অর্থনীতির তত্ত্ব মেনে ভিক্ষা দেওয়ার বিরুদ্ধে। কাল সন্ধে থেকে আমার হঠাৎ মনে হচ্ছে ভিখারীরাও আমাদের শহরগুলির ছবিতে কিছু রং হাজির করে। বেলুন বিক্রি করা মেয়েটা বড় হয়ে বেশ্যা হয়েই বাঁচুক, কিন্ত বাঁচুক। শিয়ালদহের বাচ্চা ছেলে ভিখারীটা ওই টাকায় নেশাই করুক, তাতে ওর আনন্দ হলে হোক। কিন্ত ও বাঁচুক। 

ষষ্ঠ বর্গে রাখছি সেইসব বন্ধুদের যারা এখনও সাহস, বিশ্বাস ও সহমর্মিতা হারান নি। ভুল করছেন কিন্ত গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়েও আবার ভুল শুধরে নেবেন। কারণ মানবসভ্যতা তার কঠিনতম পরীক্ষার মুখে। ভাইরাসের তার নিজের সঙ্গে যুদ্ধে আমাদের একটা অংশকে জিতে নিয়েছে। আমাদের পারষ্পরিক বিশ্বাস, মূল্যবোধ আর স্মমান। কাল সবার পরিবারে এই বিপদ আসতে পারে। তার আগে নিজেদের হারানো সম্পদ চলুন ভাইরাসের কাছ থেকে ছিনিয়ে আনি।

আমরা আরেকটু ভাবা প্র্যাক্টিস করি। সুস্থ থাকুন। আর কয়েকদিন, তারপর সবাই আমরা সপরিবারে পরের শীতকালে পিকনিক করব যে !

দেবাঞ্জন বাগচী।

Comments

Popular posts from this blog

মনন..10th Feb 2019

নাগরিক দিনলিপি ১০ : 30 th Aug 2019

মনন...2nd Nov 2019