যেতে যেতে : ১২..16thFeb 2020

যেতে যেতে : ১২
****************

এই শিরোনামে কিছু লিখে বন্ধুদের প্রায় ন'মাস জ্বালানো হয়নি, নিজগুনে বন্ধুরা বাকি একশ' সাতটি দোষ ক্ষমা করেছেন। আমার প্রলাপও সহ্য করবেন মনে করেই সাহসটা জুটিয়ে ফেললাম। আমি এখানে বেড়ানোর সময়ে ঘটে যাওয়া কিছু অভিজ্ঞতা আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিই। হিমালয় বা পিরামিড বা পাহাড়ি ঝর্ণা কয়েক হাজার বছর ধরেই সুন্দর, তাই নতুন করে বলার মত শব্দ আমার অভিধানে নেই। বলার যেটুকু আছে তা হল আমার কথা। আজ আবার আলাপ করাই আমার এক এমন বন্ধুর সঙ্গে, যার সঙ্গে আলাপ আমার বিরলতম সৌভাগ্য বলেই আমি মনে করি।

আমার মিশর ভ্রমণ ছিল বেশ অদ্ভুত। ইন্টারনেটে পরিচিয় হয় বন্ধু তারেক আর স্রোতস্বিনীর সঙ্গে। প্রথমজন জার্মান। তার বাবা মিশরীয় কমিউনিস্ট মুসলিম ও মা জার্মান, কর্মসূত্রে তারেক জার্মান রাষ্ট্রদূত হিসেবে আবার মিশরে এসেছে কিছুদিনের জন্য। সে এলেমদার লোক, ল্যাটিন আমেরিকা ঘুরেছে খালি পকেটে। কোন খাবারেই তার আমারই মতন অরুচি নেই। তার গিন্নিও কম না, সে বেটির বায়ো ডেটা আফগানিস্তান যুদ্ধে তালিবানের মর্টার থেকে পালানোর অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ। স্রোতস্বিনীর বাবা দক্ষিণ ভারতীয়, মা বাংলাদেশে জন্মেছিলেন। ওদের সন্তানের মুখে চার দেশের ভাষা। গায়ে গঙ্গা, পদ্মা, রাইন আর নীলনদের গন্ধ। আমার কলকাতার ফ্ল্যাটে প্রথমবার ওরা রাত্রিবাস করার সময়েই আমরা আপন হয়ে যাই তারেকের পায়ে শাহরুখ খানের নাচ দেখে। রক্ত মাংসের সম্পর্ক নিয়ে আমার আশৈশব অবিশ্বাস দৃঢ় হয় এমন কিছু ঘটনায়। এর পর যা অমোঘ তাই হল, ওদের উষ্ণ আহ্বানে সাড়া এবং এক ভোরে তার দরজায় খাদিমের চটি পরে টোকা দেওয়া। এভাবে বিদেশ ভ্রমণ এই প্রথম।

আমার ভোজনপ্রীতির জন্য মানুষজন সমঝে চলেন। গিয়েই প্রথম উপস্থিত হলাম বিখ্যাত রেস্টুরেন্ট "café riche"। মুজতাবার লেখা পড়ে জন্মানো অসীম দুর্বলতা। কফি হাউস ছাড়া যেমন কলকাতা হয়না, কাফে রিসে ছাড়া কায়রো হয়না। কায়রো গিয়ে পিরামিড বা মিশরীয় মিউজিয়ামের আগে এমন জায়গায় কেউ আগে ছোটে কিনা জানিনা, আমি গেলাম। কানে বাজছেন শঙ্খ- "হেঁটে দেখতে শিখুন", শিখলাম। ইজিপিসিয়, আরবি, জার্মান, ব্রিটিশ, সোভিয়েত শাসন ও আরব বসন্তের স্মৃতি সমৃদ্ধ "তাহরির স্কোয়ার" থেকে মুগ্ধ চোখে ঐতিহাসিক ঔপনিবেশিক বাড়ি ও রাস্তাগুলি দেখতে দেখতে, পৌঁছে গেলাম রাষ্ট্রীয় মিউজিয়ামে। তা যে কত অসাধারণ জানানোর জন্য ফেসবুকেই অসংখ্য লেখা পাবেন। আমি একটা কথাই বলব, জেটল্যাগসহ দুই দিন/এক রাত জেগেও সস্ত্রীক ছয় ঘন্টা মিউজিয়াম দেখেছি দাঁড়িয়ে। ক্লান্ত হইনি, শেষও হয়নি, ক্ষিদেও মেটেনি। কর্তৃপক্ষ বন্ধ না করে দিলে থামার কারণ নেই। অগত্যা সন্ধেবেলা ঘরে ফেরা। আমার বাহন হল ষাট বছর আগের সোভিয়েতের সুদিনের স্মৃতি বিজড়িত হলুদ কালো "লাদাস" ব্র্যান্ডের ট্যাক্সি। ছাত্রজীবনে অর্থনীতি পড়ার বহু গুন আছে। গন্তব্যস্থল ও মিটার রিডিং দেখে বুঝে নিলাম কলকাতা এবং কায়রোর ট্যাক্সিভাড়া প্রায় এক। এহেন ট্যাক্সির মিটারের একক আবিষ্কার আমাকে সাফল্যের সঙ্গে সাহায্য করবে আগামী তেরো দিন, অজানা দোকানে ও ফেরিওলার কাছে দরদাম করতে। তবে সবকিছুর অত সহজে সরলীকরণ হয়না, সেই প্রমাণও পেলাম সেদিন।

তারেকের বাসায় সাজ সাজ রব। আমরা ছাড়াও নৈশহারে হাজির আরেক অতিথি। তারেকের সহপাঠিনী- করিন ওয়াগনার। স্রোতস্বিনী নানা দেশের cuisine রান্না করতে জানে। বহু রকম রান্নার প্রস্তুতি চলছে। ওরা বারণ করলেও আমরা লেগে পড়লাম। ওখানে কাজের লোকের concept নেই। আমার মত অকাজের লোকও সিধে। এরপর কায়রোর ছয়দিন আমরা চারজন হাতে হাত মিলিয়ে রান্না থেকে বাসন ধোয়া, সবই করব। 

আমি করিনের সঙ্গে গল্প শুরু করলাম ফল/সবজি কাটতে কাটতে। করিন জার্মান হলেও থাকে ফ্রান্সে, একেবারে জার্মানি ঘেঁষা ফ্রান্স। তার কত্তা জীবাণু বিশারদ। মানে কোন ব্যাধি যাতে pandemic না হয় তার গবেষণায় মগ্ন। আর এক দুই লাইন পেরিয়েই আমরা সার্স পেরিয়ে চলে এলাম কেরলের "নিপা" ভাইরাসে। কিছুদিন আগেই সবে আমরা নাম শুনেছি, ভদ্রমহিলা বিষয়টি "কেরল" রাজ্যের নাম সহ জানেন, নড়েচড়ে বসলাম। বলা যায় করিনের সঙ্গে আমার "নিপা"তনে সন্ধি হল। এরপর দেখলাম কেরল বা রাজস্থান যে বেড়ানোর জায়গা, "উমা" যে দেবীর নাম, কলকাতা জাদুঘরে মমি আছে, বা ভারতে যে চরম বামপন্থীরা গেরিলা যুদ্ধ লড়ে যাচ্ছেন - এসবও ওঁর অজানা নয়। এবার কিন্ত কিন্তু করে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম ওঁর পেশা নিয়ে। বললেন উনি মূলতঃ "Negotiator", এবং এই কাজে আফ্রিকাবিদ। অর্থাৎ আফ্রিকার দেশে দেশে যে গৃহযুদ্ধ চলছে, সেগুলোই ওঁর কর্মক্ষেত্র। এসব গৃহযুদ্ধে পয়সা বানায় পশ্চিমি দেশ বা warlordরা। আর দাম দেয় মহিলা ও শিশুরা। সুদীর্ঘ অত্যাচার ও ধর্ষনের পর মেয়েদের হয় বেচে দেওয়া নয় মেরে ফেলা হয়। ছেলে শিশুদের ভবিষ্যত মেরে ফেলা বা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হাতে বন্দুক দিয়ে যুদ্ধে বা ড্রাগ কেনাবেচায় পাঠানো। এদের ধরা আর মেরে ফেলার মাঝখানের যে সল্প সময় সেই সময়ে খুব যোগ্যতা সম্পন্ন কিছু মানুষ দরদাম করে কয়েকটি প্রাণ বাঁচাতে পারেন। আমার সামনে টমেটোতে ভূমধ্যসাগরীয় অলিভ অয়েল মাখাতে মাখাতে খিলখিল করে হাসা, পঞ্চাশোর্ধ, প্রাণখোলা মহিলা তাদের মধ্যে অন্যতমা। এঁদের জঙ্গিরা বিশ্বাস করেনা, কারন শিশুদের আদান প্রদানের সময় "NATO" জাতীয় সংগঠন অতর্কিতে হামলা করতে পারে, অন্যদিকে দেশের সরকার বা ইউনাইটেড নেশনও বিশ্বাস করে না। কারন মাঝপথে চাইলে কেউ টাকা সরাতে পারে। এক হাতে টাকা দেওয়া আর অন্যহাতে পনবন্দী গুনে নেওয়া, এটা অনেক সময় হয় দু'পক্ষের বন্দুক আর স্নাইপারের নিশানায়। করিনদের সাদা জ্যাকেটে খেলা করতে থাকে অসংখ্য স্নাইপারের লাল লেজার আলোর আল্পনা। সেই আল্পনা গায়ে মেখে, শুভ আর অশুভের দাবার সাদা-কালো ছকে যুদ্ধের মধ্যেই বারবার জীবন ছিনিয়ে আনে করিনরা। এ নেশার মত গভীর নেশা হয়না। যার লেগেছে তার আর ছাড়বে না।

এসব করতে করতে আর বাচ্চা নেওয়া হয়নি। করিন ও তাঁর স্বামী এভাবে একদিন নাইজেরিয়ায় দেখা পেয়ে যান লিওর। প্রথম দর্শনই যথেষ্ট ছিল লিওর, ওর বাবা মা'কে চিনে নিতে। সে ভারী লাজুক, কোমল আর মিষ্টি স্বভাবের ছেলে। বেশ কবি কবি ভাব সম্পন্ন মানুষ। গর্বিত ককেশীয় বাপ মায়ের লাজুক নেগ্রিটো শিশু খুব সরল বিশ্বাসে বেশি সাদা ক্রিম মাখে। এক শ্বেত শিশুর সঙ্গে দুষ্টুমি করছিল একবার, তাতে শ্বেত শিশুর মা এসে একবার ধমকি দেয় - তাকে আবার তার কালো মায়ের কাছে পাঠানো হবে। সেবার লিও'র জ্বর এসেছিল। তবে এই নিয়ে আমার বলা সাজে না। রূপের গুমোর আমাদের দেশের মানুষ করে না, এমন যদি বলতে পারতাম খাসা হত।

খেতে খেতে করিনকে জিজ্ঞেস করলাম, ওর পড়াশোনা কি নিয়ে। আশ্চর্য হয়ে বলল - পলিটিকাল সায়েন্স। যেটা অব্যক্ত সেটা ছিল, আর কোন সাবজেক্ট নিয়ে পড়াশোনা করে এই কাজ করব ! মনে পড়ে যাচ্ছিল আমার দেশে পল সায়েন্সের ছেলেমেয়েদের দুর্দশা। ওই বিদ্যার চর্চা করে যে এমন একটা জায়গায় আসা যায়, আমাদের স্বপ্নের অতীত। মিশরের প্রথম দিনই আমার অভিজ্ঞতার দিগন্তকে বাড়িয়ে দিল অনেকটা। যতটুকু দেখেছি করিন আফ্রিকান সংকট থেকে বেশিদিন দূরে থাকতে পারে না। শেষ যখন করিনকে মেসেজ করি, তখন ও লিওকে বড়দিনে বাবার কাছে দিয়ে তৈরি হচ্ছে আফ্রিকায় জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াইতে। কোন ডাক আসেনি কিছুদিন ইউনাইটেড নেশন বা নেটো থেকে। ও এক এন জি ও'র সঙ্গে চলেছে লম্বা সফরে, বলল - I am flying to Goma via Adis Abeba but there is a first project from "Doctors without Borders" ...ebola coordination. From there I fly with a little plane to Bunia...then another project, It will take a 6 hours drive to.......

আমিও করিনের সঙ্গে এমন এক দিনের স্বপ্ন দেখি, যেদিন আফ্রিকাতে ধনী রাষ্ট্রগুলোর মদতে এসব সন্ত্রাস বন্ধ হবে। ওর মত আল্পসের আমেজ ছেড়ে আফ্রিকার বিপজ্জনক জঙ্গল আর জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে দর কষাকষির খেলা আমার সাধ্যাতীত। তবে উপরওয়ালা বলে কিছু থাকলে, এই মহিলাকে যে বিশেষ যত্ন করেই বানানো হয়েছে, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। আমি এমন অবাক ছিলাম যে ওর ছবি তুলতে পারিনি সেদিন। তবে আমার আধা জার্মান ভাইপো আকাশ আর আধা ইউরোপীয় ভাগ্নে লিও'র ছবিটি তুলে রেখেছিলাম। অনেক বড় হল লেখাটা, পড়ার জন্য ধন্যবাদ। আর একটা অনুরোধ আমার জগাই মাধাইয়ের জন্য শুভকামনা প্রার্থনীয়। 

দেবাঞ্জন বাগচী।

#যেতে_যেতে_১১র_লিঙ্ক
https://m.facebook.com/photo.php?fbid=2722582641147691&id=100001879454450&set=a.1136977163041588

Comments

Popular posts from this blog

মনন..10th Feb 2019

নাগরিক দিনলিপি ১০ : 30 th Aug 2019

মনন...2nd Nov 2019