নাগরিক দিনলিপি ২
চোখের সামনে ফুটপাথে চাওমিন বানাতে বানাতে এক কিশোর যুবক হল। আগে বানাত ওর দিদি। দুই বিহারি ভাই বোনের চেহারায় রুক্ষতার সঙ্গে সৌন্দর্য যেন বিনুনি করা ছিল। সেই কিশোরী আজ হয়ত নারী হয়ে তার নিজের সংসার সাজাচ্ছে। ছেলেটিও আজ এক নাগরিক, কর্মনিষ্ঠ ও পরিশ্রমী কারিগর -যে নিজের অজান্তেই দেশ বানাচ্ছে। মাঝে ফোন আসলে দূরের কোন আত্মীয়কে অভয় দেয় আজই টাকা পৌঁছে যাবে। অনেকের থেকেই মনে হয় এ দায়িত্ববান। এদের মধ্যে এক অসাধারণ গল্প ছিল আমি নিশ্চিত, কিন্ত খুঁজিনি। আমার অনুসন্ধিৎসা গল্পটার পেলব অংশে পৌঁছতে পারবে না বলে বিশ্বাস।
ওদের পাশেই বেলুন বেচে এক মধ্যবয়সী পুরুষ। তার পাশে বসে থাকে দুই পথশিশু। বেলুনগুলো ফোলেনা, সেগুলো ওরা পায়। সন্ধেবেলা তার মধ্যে দু'একটা ফুলে উঠলে ওরা এত আনন্দ পায় তা আমি দামি রেস্তোরাঁতে নৈশভোজেও পাইনা। এই বেলুনওয়ালা একদিন দেখলাম ওদের কেউ না হয়েও বাদাম কিনে দিল। কিছু মানুষ হয়ত স্বভাবে অভিভাবক হয়। তারা সব ভালবাসাতেই অভিভাবক। আনন্দ পাওয়ার পথগুলো মনে সহজ, আমিই জট পাকিয়ে ফেলেছি।
আরো কিছুদূরে বসে এক মুচি, তার পাশে এক পেয়ারাওয়ালি। সারা বছরই পেয়ারা বিক্রি করে, বারুইপুরে সারাবছর পেয়ারা হয়? তাদের মাঝে এক ভবঘুরে, ডেরা বেঁধেছে সরকারি অফিসের বন্ধ দরজার সামনে। ও পাগল নয় বলেই আমার ধারনা। একদিন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের ফেলে দেওয়া এডিশন পড়ছিল। পথে ফেলে দেওয়া জীব ও জড়ের মধ্যে গড়ে ওঠা সম্পর্ক দেখছিলাম রুজির সন্ধান করতে করতেই।
এক শীতের সন্ধেবেলা দেখলাম ওর তোষক আগুনে পুড়ে যাচ্ছে। কেউ সিগারেট খেয়ে ফেলেছিল। যেমন আমিও হয়ত জীবনে করেছি বহুবার। ওদিকে পেয়ারাওয়ালি মাসি জল ঢেলে আগুন নেভানোর চেষ্টা করছেন, মুচি ভবঘুরেকে শাসন করছে। শীতকালে অভাবের সংসার থেকে এই মুচিই একটা তোষক এনে দিয়েছিল। ভদ্রমহিলা খুবই উদ্বিগ্ন, এই শীতের রাতে ও শোবে কোথায়!
আমি হকারপ্রেমী নই। হাঁটার সময়ে এদের উৎপাতে প্রচুর গালি দিয়ে থাকি ও কবে দেশ ইউরোপ হবে ভাবি। সেদিন প্রথম দেখলাম তিন অপরিচিত মানুষকে একসাথে গেঁথেছে ফুটপাথ। এও এক জতুগৃহ । তোষকই তো ওর ঘর ছিল, এরপর হয়ত ও চলে যাবে অন্য কোথাও। আবার মিলিয়ে নিচ্ছিলাম আমার প্রিয় জীবনদর্শন, জীবন এক পথ। যা গিয়ে মিলবে আরেক পথে, চলতে থাকবে। বড় পথের মধ্যেও থেকে যায় ছোট এক গলি। যেভাবে আমাদের মধ্যে থেকে যায় কিছু মানুষের স্মৃতি ও শিক্ষা।
ওদিকে সেই ভবঘুরে কিন্ত প্রায় উদাসীন। শুধু একটু মোহিত অনুভূতি চোখে ধরা, আগুন আর ধোঁয়া দেখে। উল্টোদিকের গৃহসজ্জার দোকানের উদ্ধত আলোয় ওর মুখ উদ্ভাসিত। একজোড়া সুন্দর চোখ আড়াল সরিয়ে তাকিয়ে আছে। কোন খেদ নেই, বিষ্ময় থাকলেও থাকতে পারে।
আমি চোখের ভাষা কম বুঝি। তবে মনে হল এই চোখ নিয়েই ওপেনহাইমার প্রথম পরমানু বোমা ফাটার পর বলে উঠেছিলেন গীতার শ্লোক - I am become death, the destroyer of worlds.
Comments
Post a Comment