নাগরিক দিনলিপি ৩
পয়লা বৈশাখে গ্রীষ্ম ছুটি দিয়েছে শহরবাসীদের। সকালে লাল কৃষ্ণচূড়ার ছায়ায় ফুটপাথে হাঁটার সময় মৃদুমন্দ বাতাস। এখনও বসন্তকে যাওয়ার ছাড়পত্র দেয়নি বৈশাখ।
ঘরে ফেরার পথে এটিএম-এ রসভঙ্গ। চার হাজার টাকা চাইতে একজোড়া দু'হাজারি নোট। একটায় আবার পেন দিয়ে লেখা! প্রায় বজ্রাঘাত। একটু পরেই দুই পাওনাদার আসবেন যাদের দিতে হবে চারশ' টাকা। ঘরে ফিরেই অগত্যা বেরোলাম বাজারের ব্যাগ হাতে। জোর করে কিছু জিনিসপত্র কিনতে, উদ্দেশ্য টাকা ভাঙানো।
আলু, পেঁয়াজ, আদা, রসুন মিলে বিরাশি টাকা। চটপটে দোকানদার ছেলেটি বলল, তুমি আশি টাকাই দাও দাদা।
সোৎসাহে নোট বের করতেই বলল, এই খুলেছি দাদা, বাজার করে এসে দিও।
- আরে বাজার হয়েই গেছে। আর কিছু নেবনা। দেখনা, হয় কিনা।
ছোকরা বলল, না গো দাদা। তুমি পরেরদিন দিও।
ফ্রিজে ভরতি মাছ। বাড়িতে প্রতিরোধ আসবে জেনেও গেলাম মাংসের দোকানে। এ আমার চেয়েও বুদ্ধিমান। লেখা টাকার বিনিময়ে, মাংস বিক্রি করে দিল তিনটি রঙ লাগা পাঁচশ' টাকার নোট। আপত্তি করতেই মৃদু বচসা। অবশেষে বলল, খুচরা নেই হ্যায় তো হাম কা করেগা। আপ কাল আকে দে দিজিয়ে। অর কোই চারা নেহি হ্যায়।
চারা নেই বলেই বেচারা শব্দটি এসেছে। আমার ব্যাকরন বিদ্যা সমৃদ্ধ হল চারশ' ত্রিশ টাকা ধারের বিনিময়ে। একটু পরেই এসে ফিরে যাবে আরো দুই পাওনাদার। মোট ধার দাঁড়াবে আটশ' ত্রিশ। সকালে এখনও মুখ ধোওয়া হয়নি। আমি ধার নেওয়ার ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে টেক্কা দিচ্ছি। তাও আবার হালখাতার দিন!
হাতে থলে নিয়ে এবার আমি ঘামছি এক বন্ধ দোকানের সামনে। কেন যে তখন তিন হাজার ন'শো টাকা তুললাম না! মনে হল আরো অপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনা যাক। কেউ না কেউ দিয়েই দেবে। মনে পড়ল বাজারের ভেতর বড় মুদিখানা আছে। পায়ে পায়ে বাজারের ভেতর চলেছি। সরু গলি দিয়ে কোনমতে একজনই যেতে পারে। রাস্তার পাশে ছোট্টঘরে কারিগর জুতো বানাচ্ছে। পাশে কসাইখানায় গবাদি ঝুলছে। ভাবলাম শিকার কে তো বুঝছি, শিকারিটা কে? আমি না কসাই। এক পুরোনো বাড়ির সিঁড়িতে পাশাপাশি বসে দুটো দেশি কুকুর, একটা বেড়াল আর এক মোরগ দাঁড়িয়ে। বাজারের কি 'অনির্বচনীয় মহিমা'।
বড় মুদির দোকানে দেখি পরিচিত দোকানদার নেই। এক বৃদ্ধ মুখে মাস্ক পরে বসে আছেন। ছেলে গেছে দোকানে পূজার জোগাড় করতে। এক বোতল আমের স্কোয়াশ নেব শুনে টাকা ভাঙিয়ে দিতে রাজি হলেন। দুরুদুরু বুকে বাড়িয়ে দিলাম লেখা টাকাটা। অনভিজ্ঞ হাতে নিয়ে না দেখেই, রেখে দিলেন ক্যাশবাক্সে। গুনতে লাগলেন চেঞ্জ।
এবার আমার নজর গেল ওঁর মাথার দিকে, একটাও চুল নেই। ভঙ্গুর সাস্থ্য। মুখে মাস্ক। মনে পড়ে গেল এক নিকটাত্মীয়ের কথা। ক্যানসার কিছুদিন আগেই তাঁর জীবন নিয়েছে। তাঁর মাথাও এমনই ছিল, মুখে মাস্ক পরতেন শেষ পনেরদিন। ওঁকে বলব কিনা ভাবছি টাকায় পেন দিয়ে লেখা আছে, ইতিমধ্যে আমায় চেঞ্জ বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, সন্ধেবেলা এসো বাবা আবার। পুজো হয়নি এখনও।
টাকা গোনার ক্ষমতা হারিয়েছি। চেয়ে রইলাম ফ্যালফ্যাল করে।
Comments
Post a Comment