নাগরিক দিনলিপি ১


ছেলেবেলা থেকে শুনে এসেছি কিছু শুনতে না পারলে বলা হয়, তুই কি কালা?
কিছু দেখতে না পেলে, তুই কি অন্ধ?
বুঝতে না পেরে চুপ থাকলে, তুই কি বোবা?
ভাল কিছু দেখতে পেলে অনেকেই বলেন, দেখলে চোখ ট্যারা হয়ে যাবে। সত্যি বলতে কি ট্যারা, তোতলা, কালাদের নিয়ে রসিকতা করারও বেশ প্রচলন আছে। বাচ্চাকাচ্চা নয়, বড়রাও বাদ দেন না। ডিভোর্সি, অবিবাহিত মানুষেরা তো রীতিমতো যাকে বলে 'খোরাক'। সমকামী বা লিঙ্গহীনরা তো মনুষ্যপদবাচ্যই না। সেই মানুষটার বেঁচে থাকাকে আমরা কতটা কণ্টকাকীর্ণ করলাম তা ভাবার সময় বা দায় আমাদের নেই। অথচ এই লিঙ্গহীন মানুষটির কাছে তার বাড়ির লোক এসে মাসের শেষে টাকা নিয়ে যান। সে আমাদের কাছে বিকট জীব, ঘৃণ্য, ব্রাত্য। বাড়িতেও বোধহয় অস্পৃশ্য, সবার মুখ পুড়িয়েছে জন্মে।
বলাই বাহুল্য ট্যারা, কালা, বোবা, হিজরে এগুলো আক্ষরিক অর্থে কেউ বলেন না। তবে বলা উচিত কিনা সেই প্রশ্ন কি অপ্রাসঙ্গিক? আমাদের জীবন ও জীবিকা বহুলাংশেই গার্হস্থ্য কর্মীদের, বিশেষত নারীদের ওপর নির্ভরশীল। এঁরা প্রান্তিক মানুষ। খুবই দরিদ্র। আমি নিজে তেমন একজনের স্নেহে বড় হয়েছি। বড় কষ্টের জীবন ছিল তাঁর। আমি কিন্ত ওঁকে কিছুই দিতে পারিনি। হিসাববিদ্যার ছাত্রের বড় ব্যর্থতা সেই ব্যালান্স শিট মেলাতে না পারা। বোধহয় আমার চোখের অভিযোজন হয়েছে খাঁটি বস্তুনিষ্ঠ পদ্ধতিতে। যাতে সুবিধা, তা চোখ দেখে নেয় অতি সহজে। আসলে আমিও অন্ধ।
জীবনে মানুষ অনেক ভাল কথা বলেছেন। যথারীতি যা ভাল লেগেছে তাই শুনেছি, যা শুনলে উপকার হবে কিন্ত কষ্টকর তা শুনিনি। ফুটপাথবাসী মা রুগ্ন সন্তান কোলে নিয়ে পয়সা চাইলে শুনিনি। পকেটে হাত ঢুকিয়ে ব্যস্ততার ছলে পেরিয়ে যাওয়া রপ্ত করেছি। আবার এই আমিই ডাক্তারের চেম্বারে দুই ঘন্টা অপেক্ষায় থেকে মৃদস্বরে 'দেবযানী বাগচী' দশফুট দূর থেকে শুনে বলে উঠেছি- 'ওটা দেবাঞ্জন বাগচী হবে'। কান তার সুবিধা অনুযায়ী কাজ করে, আসলে আমিও কালা।
আমার বন্ধুতালিকায় কিছু পুলিশ বন্ধু আছেন। তাঁদের প্রতি ব্যক্তিগত সম্মান রেখেই বলছি, আমি পুলিশদের উপর প্রসন্ন নই। একবার নিশুতি রাতে একজনের রক্ষার জন্য দরকার হল প্রশাসনের সহায়তা। ঘোর বিপদ। আইনরক্ষক এসে নিরাপত্তা দিলেন দেবদূতের মতন। পারিশ্রমিক নিয়েও গেলেন, ভ্যাম্পায়ারের মতন। দেখলাম আসলে আমি বোবা।
এমনিতে ট্রেনে-বাসে কথার ফুলঝুরি ছোটাই ঘটে চলা অবিচার নিয়ে। আবার ট্রেনেই একদল নিত্যযাত্রী একদিন বাদানুবাদ হতে হতে এক মহিলাকে মারলেন। বেশি না, এক চড়। তখনও দেখলাম আসলে আমিই এক লিঙ্গহীন।
ইতিমধ্যে এক বন্ধুর দেখা পেলাম। একই বিষয় নিয়ে পড়েছি আমরা। সে আমার চেয়ে অনেক যোগ্য ছাত্র। পরীক্ষার ঘরে সাহায্য করেছে একসময় আমাকে। এখন এমন এক চাকরি করে যাতে বেঁচে থাকার খাওয়াটুকু জোটে, জীবনের সুকুমার দিকগুলো মরে যায়। সেই আমাকে মুড়ি আর চা খাওয়াল। যাওয়ার আগে জড়িয়ে ধরে বলে গেল, সালা! ভাল চাকরি করিস বলে তোকেই খাওয়াতে হবে নাকি! আর তুই তো কত চা খাইয়েছিস একসময়।
বড় শহরগুলো আমাদের অনেককিছু দেয়। নিয়েও নেয় অনেক, তার হিসেব করে দেখিনা আমরা। আজ আবিষ্কার করলাম তাকিয়ে আছি ভিক্টোরিয়ার পরির দিকে। কর্মজীবনের প্রথম থেকেই পরিটা আমায় খুব টানে। অনেক কিছু ভুলিয়ে দেয়। আজ দেখলাম আমি বন্ধুর কথা শুনছি, ওর দিকে না তাকিয়ে। এভাবেই কিন্ত ওর চোখের ভাষা দেখতে পাচ্ছি। দেখতে পাচ্ছি একগাল হাসি। আমিও এক প্রতিবন্ধী, আমি ট্যারা হয়ে গেছি।
নাকি ট্যারা হতেও শিখে গেছি!!




Comments

Popular posts from this blog

মনন..10th Feb 2019

যেতে যেতে ৫ :: 22nd July 2018

যেতে যেতে ৪ : 7th July 2018